সীমান্ত প্রধান

  ২৩ অক্টোবর, ২০১৭

আন্তর্জাতিক

স্বার্থের শিকলে বন্দি চীন ও রাশিয়া

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো হত্যাযজ্ঞকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারা দাবি করেছে, তাদের কাছে এই অপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। একই সঙ্গে অ্যামনেস্টি মিয়ানমারের প্রতি সবরকম নিষেধাজ্ঞা জোরদার করতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। গত ১৮ অক্টোবর রোহিঙ্গা ইস্যুতে অ্যামনেস্টি নতুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো হত্যা, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন এবং জোর করে দেশত্যাগে বাধ্য করার বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরা হয়।

অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু সবাই দেশটির সেনাবাহিনীর কৌশলগত নিধনের শিকার। এদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানালেও দেশটি কোনো কর্ণপাত করছে না। ফলে এ সংকট সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহল। এতে করে এটুকু প্রতীয়মান যে, চলমান রোহিঙ্গা সংকট সহসা শেষ হওয়ার নয়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা ইস্যু বেশ ভালোভাবেই ভোগাবে। শেষতক এই সংকট শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হবে কি না, এই নিয়েও দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন।

গত দু’মাসের বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। ফলে প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আবালবৃদ্ধাবনিতা এসে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। চলমান এ সংকট নিরসনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কার্যত সুফল নেই। ফ্রান্স, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর কোনো আহ্বানই পাত্তা দিচ্ছে না অং সাং সু চির মিয়ানমার। এ পরিস্থিতিতে দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নসহ তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে ইউরোপ, আমেরিকা মিয়ানমারের প্রতি ক্ষুব্ধ হলেও চীন, রাশিয়া, ভারত ও ইসরায়েল এসে দাঁড়িয়েছে তাদের পাশে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন নিয়েই রোহিঙ্গা নিধনে মাঠে নেমেছে মিয়ানমার!

মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকার পরও মিয়ানমারের পাশে চীন, রাশিয়া ও ভারতের অবস্থানের নেপথ্যে রয়েছে বৃহত্তর বাণিজ্য স্বার্থ, তা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মূলত এ কারণেই চীন ও রাশিয়া চলমান সংকট সমাধানে আনান কমিশনের সুপারিশের বিপক্ষে ভেটো দিয়ে আসছে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরের ইকোসক চেম্বারে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের উদ্যোগে এ বৈঠক বসে। বৈঠকে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। তবে এর বিপরীতে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান ছিল পূর্বেকার মতো। এ কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ বৈঠকেও কোনো প্রস্তাব আনা যায়নি।

বৈঠকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশের প্রতিনিধি ছাড়াও মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, অফিস অব দ্য হাইকমিশন অব হিউম্যান রাইটস, অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স, ইউএনএইচসিআর, ওআইসি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা এ বৈঠকে বক্তব্য রাখেন। বৈঠকে রোহিঙ্গা নিধন বন্ধ ও আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত একটি পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা থাকলেও চীন ও রাশিয়ার ভেটোর কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তারপরও বৈঠকটি ইতিবাচক বলেই মনে হচ্ছে। কেননা, বৈঠকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় নিন্দা জ্ঞাপনসহ আনান কামিশনের সুপারিশের সঙ্গে জাতিসংঘের সদস্য দেশসহ বেশ কয়েকটি দেশ সংহতি প্রকাশ করেছে।

চলমান রোহিঙ্গা সংকটকে মানবিক বিপর্যয় হিসেবেই দেখছে যুক্তরাজ্য। বৈঠকে দেশটির প্রতিনিধি বলেছেন, ‘এনাফ ইজ এনাফ। মিয়ানমারের এই দমন-পীড়ন আমরা আর সহ্য করতে পারছি না। তাদের সামরিক বাহিনীর এই হীন কাজের নিন্দা জানাই।’ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধির কণ্ঠে একই সুর ছিল। তারা অনতিবিলম্বে মানবিক সহযোগিতা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি, সহিংসতা বন্ধ, জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের পূর্ণ প্রবেশাধিকার, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ ও নিশ্চয়তার সঙ্গে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনসহ কফি আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণ বাস্তবায়নের পক্ষে জোর দিয়েছে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনা এবারই যে প্রথম, তা নয়। এর আগেও এমন ঘটনা তারা বহুবার ঘটিয়েছে। প্রতিবারই বিশ্ব জনমত মিয়ানমারের বিরুদ্ধেই গিয়েছে। তবে কোনোবারই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারেনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। তবে এবার তারা চাইছে এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। এ জন্য আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। তবে মিয়ানমার সরকার এ ব্যাপারে ‘ডেম-কেয়ার মুডে’ই রয়েছে। মূলত চীন, রাশিয়া, ভারতকে পাশে পাওয়ায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আহ্বানকে তারা পাত্তা দিচ্ছে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ফলে চলমান রোহিঙ্গা সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে।

এদিকে মিয়ানমার সরকারের পাশে চীন, ভারত, রাশিয়ার অবস্থানটা যে সম্পূর্ণভাবেই বাণিজ্যিক, তা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। দেখা গেছে, মিয়ানমারে সবচেয়ে বেশি বিনোয়োগ করেছে চীন। পরিসংখ্যান বলছে, বিগত ৩০ বছরে এ দেশে চীনের বিনিয়োগ ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া চীন নতুন করে রাখাইনে একটি গভীর সমুদ্র প্রকল্পে ৭৩০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে সেখানে একটি শিল্পপার্ক এবং একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলারও পরিকল্পনা আছে তাদের। শুধু তাই নয়, চীনের সিআইটিআইসি করপোরেশন রাখাইনের গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের ৭০-৮০ শতাংশ শেয়ার চেয়েছে। এটি নির্মাণ হলে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এবং চীন বঙ্গপোসাগরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। তাছাড়া ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের কাছে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে চীন। পরিসংখ্যান বলছে, চীনের কাছ থেকে ১২০টি বিমান, ১ হাজার ২৯টি ক্ষেপণাস্ত্র, ২১টি রণতরী, ১২৫টি কামান, ৬৯৬টি সাঁজোয়া যান কিনেছে মিয়ানমার। তবে চীনের তুলনায় ভারতের বিনিয়োগ খুব একটা বেশি না হলেও তা বাড়ানোর কৌশলেই মোদি সরকার মিয়ানমারের পাশে থেকে যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি, মিজোরাম থেকে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত সড়ক বানানোসহ বেশকিছু পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে তারা। এছাড়া বিগত ২৬ বছরে মিয়ানমারের কাছে বেশ কিছু অস্ত্র ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামও বিক্রি করেছে এ দেশটি।

অপরদিকে রাশিয়া মিয়ানমারের সঙ্গে অস্ত্র বাণিজ্য ছাড়াও কিছু বণিজ্যিক চুক্তি করেছে। পরিসখ্যান বলছে, ৬৪টি বিমান, ২ হাজার ৯৭১টি ক্ষেপণাস্ত্র, ১০০টি কামান মিয়ানমারের কাছে বিক্রি করেছে দেশটি। পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে আরো বেশ ক’টি সামরিক ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে অং সান সু চির মিয়ানমার। শুধু তাই নয়; বিমান বিক্রিতে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে মিগ কোম্পানি মিয়ানমারে একটি অফিসও খুলেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাশিয়ার কাছ থেকে মিয়ানমার এ পর্যন্ত ৩৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের অস্ত্র ক্রয় করেছে।

মিয়ানমারের সঙ্গে শুধু অস্ত্র ব্যবসাই নয়; নানামুখী বাণিজ্যিক দিকেও নজর দিয়েছে রাশিয়া। এর মধ্যে অর্থ সহায়তা (বিনিয়োগ) ও প্রযুক্তি রফতানি উল্লেখযোগ্য। মিয়ানমারে দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি চুক্তি (২০১৩) করেছে রাশিয়া। ইতোমধ্যে কাজ শুরুও করেছে তারা। একই সঙ্গে মিয়ানমারে বিপুল খনিজ সম্পদ আহরণে রাশিয়া ইতোমধ্যে দেশটিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মিয়ানমারের তেল-গ্যাসের ভান্ডারের মুনাফায় নিজ আধিপত্য ধরে রাখতে রাশিয়ার সরকারি কোম্পানি ‘গাজপ্রম’ মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে অফিসও খুলেছে। এছাড়া মিয়ানমারকে শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের সহায়তাও দিচ্ছে রাশিয়া। ১৯৯৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৭০৫ শিক্ষার্থী রাশিয়ায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যে ৭শ’ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেছেন পারমাণবিক বিদ্যায়। এছাড়া রাশিয়ার সরকার মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে উচ্চতর প্রশিক্ষণও দিচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।

এতে করে বোঝা যাচ্ছে, চলমান রোহিঙ্গা সংকটে চীন ও রাশিয়ার মানবতা বোধ বৃহত্তর স্বার্থের শিকলে বাঁধা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিন্দা জানানোর পাশাপাশি এ ঘটনাকে মানবতাবিরোধী আপরাধ হিসেবে অখ্যায়িত করলেও চীন ও রাশিয়া মানবতা বোধের মাথা খেয়ে এখনো পর্যন্ত মিয়ানমারের পাশে থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তারা বারবারই ভেটো দিয়ে আসছে। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও দেশত্যাগে বাধ্য করার জঘন্য এক অমানবিক অপরধাকে উসকে দিচ্ছে তারা। এরপরও আমরা আশা করব, চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের অমানবিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াসহ এসব বন্ধে বিশ্ব সম্প্রদায় মানবতার পক্ষে কণ্ঠ মেলাবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist