রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৬ জুলাই, ২০১৭

আন্তর্জাতিক

বর্ণবাদী আক্রমণ আতঙ্কে ব্রিটেন

বহুজাতিক ও বহুভাষিক মানুষের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিশেষ সুনামের অধিকারী যুক্তরাজ্যে সংখ্যালঘুর জীবন বিপন্ন হওয়ার ঘটনা ক্রমশই বাড়ছে। গত ১১ মাসে বর্ণ ও ধর্মবিদ্বেষী ঘটনা ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টের রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের বেশি ঝুঁকির মুখে বলে বিবেচনা করছেন। ব্রেক্সিট গণভোটের পর থেকে ব্রিটেনে বর্ণ ও ধর্মবিদ্বেষী আক্রমণের ঘটনা বৃদ্ধি নজিরবিহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ে এধরনের ঘটনা ছিল ৪০ হাজার ৭৪১টি। আর এ বছর সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার ৯২১টি। বছরওয়ারী হিসেবে এই বৃদ্ধি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। কল্যাণরাষ্ট্র ব্রিটেন নিজের প্রয়োজনে হোক আর মানবিক দায়-দায়িত্ব থেকে হোক এদেশে আসা অভিবাসী মানুষকে বরণ করে নিয়েছে। এরা এই দেশের অর্থনীতি এবং সমাজে নানাভাবে অবদান রেখেছেন। এনএইচএস তো চলে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর কর্মীবাহিনী দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষজন বদলে দিয়েছেন এদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস। কিন্তু আমরা জানি, নানা হিসাবনিকাশে অভিবাসী জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্র এদেশে স্থান দিলেও এদেশেরই বর্ণবাদী মহল কোনো সময়েই তা মানতে পারেনি। এই না মানার দলে মাথামু-ানো রাস্তার রেসিস্ট যেমন ছিল তেমনি ছিলেন প্রভাবশালী রাজনীতিক কেউ কেউ। ব্রিকলেন যে এখন যুক্তরাজ্যের বাঙালিদের রাজধানী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে সেখানে সত্তর দশক থেকে শুরু করে আশি এমনকি নব্বই দশক পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই রাস্তার রেসিস্টদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। আর এসব বর্ণবাদীকে পরাজিত করেই বাঙালিরা এখানে তাদের নিরাপদ আবাস গড়ে তুলেছেন। সেই লড়াই আজো ব্যাটেল অব ব্রিকলেইন বলে খ্যাত। তারও বহু আগে এই টাওয়ার হ্যামলেটস থেকে ইহুদি সম্প্রদায়কে হটিয়ে দিতে বর্ণবাদী ব্ল্যাক শার্ট বাহিনী সক্রিয় ছিল। তাদেরও পরাজয় বরণ করতে হয়েছে ব্যাটেল অব ক্যাবল স্ট্রিট খ্যাত বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ে।

যুক্তরাজ্যের ফিনসবারির হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ম্যানচেস্টার ও লন্ডন ব্রিজে হামলার পর থেকে যুক্তরাজ্যের এ দুটি শহরে মুসলিমবিদ্বেষী অপরাধের হার বেড়েছে। সাম্প্রতিক ফিনসবারি হামলার আগে থেকে লন্ডনেও ইসলামবিদ্বেষী হামলা বাড়তে দেখা গেছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও ইসলামবিদ্বেষী ঘটনা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা টেল মামার বরাত দিয়ে ‘গার্ডিয়ান’ জানিয়েছে, ম্যানচেস্টারের কনসার্টে হামলার পরের সপ্তাহে শহরটিতে ইসলামবিদ্বেষী হামলা পাঁচ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। এখন শহরটির বাস্তবতা পুরনো অবস্থায় ফিরেছে। গত ২০ জুন গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, টেল মামার হিসাব অনুযায়ী ম্যানচেস্টার হামলার পরবর্তী সপ্তাহে ১৩৯টি ইসলামবিদ্বেষী ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অথচ আগের সপ্তাহে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫টি।

ম্যানচেস্টার পুলিশপ্রধান জানান, ফিনসবারি পার্কে হামলার আগে লন্ডনেও স্বল্প মেয়াদে ইসলামবিদ্বেষী ঘটনা বাড়তে দেখা গেছে। অবশ্য সে সংখ্যাটা কত তার সংক্ষিপ্ত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

ফিনসবারি পার্কে হামলার পর দেশটির পুলিশ বাহিনী মুসলিম কমিউনিটির সুরক্ষা নিশ্চিতে নিরাপত্তা জোরালো করেছে। যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাম্বার রুড অঙ্গীকার করেছেন, যতক্ষণ প্রয়োজন সুরক্ষার জন্য, ততক্ষণ অতিরিক্ত ব্যবস্থা বজায় থাকবে। যুক্তরাজ্যের সংবাদগুলো বলছে, সম্প্রতি দেশটিতে বেশ কিছু ইসলামবিদ্বেষী ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে একটি ইসলামবিদ্বেষী ঘটনা ঘটিয়েছেন এক চিকিৎসক। ট্রমা ও অর্থোপেডিক সার্জন তিনি। নাম নাভিদ ইয়াসিন। ম্যানচেস্টার হামলায় আহতদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করা এই চিকিৎসক সম্প্রতি তার কার্যালয় স্যালফোর্ড রয়্যাল হাসপাতালে যাওয়ার পথে একজনের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ করেছেন এবং তাকে সন্ত্রাসীও আখ্যা দেন। অন্য ঘটনাগুলোর মধ্যে আছে সাউদাম্পটনে এক নারীর মাথা থেকে হিজাব ছিনিয়ে নেওয়া এবং এক ব্যক্তিকে কাচের তৈরি বোতল দিয়ে আঘাত করা। ন্যাশনাল পুলিশ চিফস কাউন্সিলের সহকারী প্রধান কনস্টেবল মার্ক হ্যামিল্টন জানান, ম্যানচেস্টার ও লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ স্বল্পমেয়াদে বিদ্বেষমূলক হামলার বেশ কিছু ঘটনা রেজিস্টার করেছে। ম্যানচেস্টারে বিদ্বেষমূলক হামলা সাময়িক বেড়ে যাওয়ার পর তা আগের অবস্থানে ফিরে গেলেও লন্ডনের পরিস্থিতি এখনো অস্পষ্ট। ফিনসবারি পার্কের হামলার আগে দেওয়া এক বিবৃতিতে হ্যামিল্টন বলেন, সন্ত্রাসী হামলা ও অন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলো বিদ্বেষমূলক হামলার সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে। আর তাই আমরা পুলিশ বাহিনীর জন্য বিদ্বেষমূলক অপরাধের কেন্দ্রীয় রিপোর্টিং বাড়িয়ে দিয়েছি যেন প্রবণতা শনাক্ত করা যায় এবং হুমকি নিয়ে পর্যালোচনা করা যায়। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাম্বার রুড বলেন, যে যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে, সে অনুযায়ী বলা যায়, যারা বিদ্বেষমূলক হামলার শিকার হচ্ছেন তাদের অর্ধেকেরও বেশি মুসলিম এবং ধর্মের কারণেই তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।

অপরদিকে মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, ইসলামবিদ্বেষী হামলার সংখ্যা গত চার বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ১২ মাসে ৩৪৩টি ঘটনা, ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ১২ মাসে ১ হাজার ১০৯টি ঘটনা এবং চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১২ মাসে ১ হাজার ২৬০টি ইসলামবিদ্বেষী ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, ফিনসবারি পার্কের হামলাটি মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রথম হামলা নয়। এবং ২০১৩ সালে ইউক্রেনের নব্য নাৎসি পাবলো ল্যাপশিন ৮২ বছর বয়সী মোহাম্মদ সালিমকে হত্যা করে। কেবল তাই নয়, একটি ‘বর্ণবাদী যুদ্ধ’ উসকে দিতে ওয়েস্ট মিডল্যান্ডের কয়েকটি মসজিদে বোমা হামলারও চেষ্টা করে ল্যাপশিন। এক বছর পর মার্সিসাইডের মসজিদে বোমা হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে আয়ান ফরমান নামে আরেক নব্য নাৎসিকে ১০ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। শুধু মুলমান-বিদ্বেষ নয়, যুক্তরাজ্যে উগ্র ডানপন্থী তৎপরতা বেড়ে যাওয়ারও প্রমাণ মিলছে। গত ডিসেম্বরে উগ্র ডান চরমপন্থী সংগঠন হিসেবে প্রথমবারের মতো ‘ন্যাশনাল অ্যাকশন’কে নিষিদ্ধ করা হয় বিদ্বেষমূলকসহ বিভিন্ন হামলায় অ্যাসিডকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে। দাফতরিক পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, গত তিন বছরে লন্ডনে অ্যাসিড ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটনের হার দ্বিগুণ হয়েছে। ইংল্যান্ডের অন্য এলাকাগুলোতে এ ধরনের অপরাধের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ ধরনের হামলার ঘটনা ২০১৪-১৫ সালের তুলনায় ২০১৬-১৭ সালে বেড়েছে। ২০১৪-১৫ সালে লন্ডনে অ্যাসিড ব্যবহার করে ১৮৬টি হামলা চালানো হয়েছিল। আর ২০১৬-১৭ সালে এ ধরনের হামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৯৭-তে। মার্চে মেট্রোপলিটন পুলিশ জানায়, লন্ডনে অ্যাসিড হামলার সংখ্যা ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ সালে লন্ডনে ২৬১টি অ্যাসিড হামলা হয়েছিল, যা ২০১৬ সালে বেড়ে ৪৫৪টিতে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া সন্ত্রাসবিরোধী সমাজচ্যুতি আইনের আওতায় সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, মার্চ ২০১৭ পর্যন্ত ১২ মাসে ১১৩ জন শ্বেতাঙ্গকে সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগের বছর এ সংখ্যা ৬৮ ছিল। অর্থাৎ, আগের বছরের চেয়ে চলতি বছর সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটনের অভিযোগে গ্রেফতারের হার ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। সন্ত্রাসবাদের সংযোগে গ্রেফতারের ১৬ শতাংশ অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত। আইএসের মতো বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই তাদের। বড়জোর তাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হওয়ার ব্যাপার থাকতে পারে। সম্প্রতি এক মুসলিম ব্রিটিশ মডেলের অ্যাসিড-সন্ত্রাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাকে মুসলিমবিদ্বেষী হামলা হিসেবে সন্দেহ করছে পুলিশ। ব্রিটেনে বাংলাদেশি ক্রিকেটার তামিম ইকবালের স্ত্রীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাকেও ইসলামবিদ্বেষী বর্ণবাদী হামলা বলে সন্দেহ করছেন কেউ কেউ। সাম্প্রতিক কিছু পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্রিটেনে মুসলিমবিদ্বেষী হামলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন হামলায় অ্যাসিডের ব্যবহার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। ক’দিন আগে পূর্ব লন্ডনে মুসলিমবিদ্বেষী হামলার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত এক বিক্ষোভে একই সঙ্গে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও। আরেক পরিসংখ্যান বলছে যুক্তরাজ্যে ইসলামবিদ্বেষী হামলার ঘটনা বেড়েছে। জুনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও ইসলামবিদ্বেষী ঘটনা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা টেল মামার বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ম্যানচেস্টার ও লন্ডন ব্রিজে হামলার পর থেকে যুক্তরাজ্যের এ দুটি শহরে মুসলিমবিদ্বেষী অপরাধের হার বেড়েছে। মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, ইসলামবিদ্বেষী হামলার সংখ্যা গত চার বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, ছুরি ও বন্দুকের ব্যবহারের ওপর সীমাবদ্ধতা থাকায় অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য অ্যাসিডকে বেছে নিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। লন্ডনের মিডলসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাংবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. সিমন হার্ডিং-এর মতে, সন্ত্রাসী গ্যাংগুলো ছুরির বদলে অ্যাসিডের দিকে ঝুঁকছে, কারণ এটি বহনে তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই এবং এর মধ্যে খারাপ কোনো উদ্দেশ্য প্রমাণ করা কঠিন।

লেখক : আন্তর্জাতিক বিষয়ক গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist