reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭

নতুন ভাবনা

সৌরবিদ্যুৎ অমিত সম্ভাবনার ক্ষেত্র

এস এম মুকুল

সৌরশক্তি পৃথিবীর প্রাচীন শক্তির অন্যতম উৎস। গতানুগতিক শক্তির বাইরে বিকল্প শক্তির উৎস হিসেবে প্রথমেই আসে সৌরবিদ্যুতের নাম। সৌরবিদ্যুৎ বাংলাদেশে অমিত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। বিকল্প শক্তি হিসেবে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান, জার্মানি, ইংল্যান্ড, চীন ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার এখন অনুসরণীয় পর্যায়ে। জার্মানিতে সব উপাদান বা উৎসের প্রাচুর্যতা না থাকা সত্ত্বেও তারা ঠিক করেছে ২০৪০ সালের মধ্যে সমগ্র জার্মানি সৌরশক্তি দ্বারা চালিত হবে। নেপালের ৬০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে। যে ৪০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে তার মধ্যে ২০ ভাগ জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ সুবিধা আর বাকি ২০ ভাগই সৌর বা জলবিদ্যুৎ সুবিধায় জীবনযাপন করছে। নেপালে সৌরবিদ্যুতের জনপ্রিয়তার কারণ হলো, সেখানকার গ্রামীণ এলাকায় ঘরবাড়িগুলো অনেক দূরে দূরে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম কারণ হলোÑ পরিচ্ছন্ন, নবায়নযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব হওয়ায় সরকার এতে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দিয়ে থাকে। চীনের বেইজিং বা সাংহাই শহরের বাড়িগুলোর ছাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে পানির ট্যাঙ্কের পাশে বিশাল সারি সারি সোলার প্যানেল। সেখানে শীতকালে সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয় ওয়াটার হিটার হিসেবে। এরিজোনা রাজ্যের সোলার প্যানেল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করেছে মঙ্গোলিয়ার ওরডোস সিটিতে তারা গড়ে তুলবে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনের চেয়েও বড় এক সোলার ফিল্ড। যেখান থেকে ৩০ লাখ বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে। চীনের সরকার ও বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থা এবং এনজিও একযোগে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে। চীন ঘোষণা করেছে ২০১১ সালে ৭০ ভাগ গ্রামে সোলার প্যানেল বসাতে ৫০ শতাংশ সাবসিডি দেবে তারা। অচিরেই চীনে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সৌর প্যানেল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হবে। শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি পিভি সেল এখন তারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করে। ভারত ২০২২ সাল নাগাদ ‘জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল সোলার মিশন’ নামে ২২ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা নিয়েছে। নিলামের মাধ্যমে ৩৭টি কোম্পানিকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। যা ২০১৭ সালে ১০ হাজার মেগাওয়াট লক্ষ্যমাত্রায় উন্নীত হবে। ভারতের বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞদের অভিমত ১ হাজার মেগাওয়াট দিয়ে ১০ লাখ ঘরবাড়িতে বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব। সৌরশক্তি নিয়ে ভারতের জাতীয় গ্রিড তৈরি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে প্রতিটি রাজ্যের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে জুড়ে দেওয়া হবে। ভারতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারিভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। সে দেশের মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছে, বছরে এক কোটি সৌর বাল্ব প্রায় ৫০ কোটি লিটার কেরোসিন তেল বাঁচাতে পারে। এর ফলে সরকারের দুই হাজার কোটি রুপি ভর্তুকি বেঁচে যাবে। পরিবেশও রক্ষা পাবে।

বাংলাদেশ সরকারের নীতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি গ্রামাঞ্চল, উপশহর এবং শহর এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। জ্বালানি সংশ্লিষ্ট আমদানি পণ্যের উৎস থেকে শুল্ক ও কর তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সোলার প্রযুক্তি জনপ্রিয়করণে সব ব্যাংক ও তার শাখাগুলোতে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ছাদে এবং বেশ কয়েকটি ব্যাংক তাদের ভবনের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্র তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, দেশের মোট আয়তনের এক ভাগ জায়গা ব্যবহার করে ৪০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। আরও দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে শুধু বায়ুশক্তি ব্যবহার করে। বাংলাদেশে ব্যবহার উপযোগী এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো গ্রিড সংযোগ দেওয়ার একটি সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছে দেশীয় গবেষকরা। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইলেকট্রনিকস এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের একদল গবেষক সৌরবিদ্যুৎকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। উদ্ভাবকরা ১ দশমিক ১ কিলোওয়াট ক্ষমতার এই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপান্তরিত শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে স্থাপন করেন। গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি বিভাগীয় ও জেলা শহরে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণে সরকারের গৃহীত নীতি, গ্রাহকদের আগ্রহ, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ বিবেচনায় এই প্রকল্প অত্যন্ত লাভজনক, দীর্ঘমেয়াদি ও ফলপ্রসূ হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে ছাওয়া রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলো। সরকার এখনই আইন করে বাধ্যতামূলকভাবে সব ধরনের বিল বোর্ডে সোলার প্যানেল সংযোজন এবং এসব জ্বালানোর সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার।

আমাদের দেশে বোরো মৌসুমে দেশে প্রায় বিশ লাখ একর চাষযোগ্য জমিতে ১৬ লাখ ৩০ হাজার সেচপাম্প ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ১৬ লাখ একর জমি চাষে ব্যবহার হয় ১০ লাখ ৮০ হাজার বিদ্যুৎচালিত সেচপাম্প। বাকি ১১ লাখ ৫৮ হাজার সেচপাম্প ব্যবহৃত হয় ডিজেলচালিত। সারা দেশে বিদ্যুৎ ও ডিজেলচালিত সেচপাম্পগুলোকে সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনা সম্ভব হলে বছরে ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও ৮০ কোটি লিটার ডিজেল সাশ্রয় হবে। যার ফলে ডিজেল ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সরকারের ৮৫৩ কোটি টাকা ভর্তুকি বেঁচে যাবে। এই ভর্তুকির টাকা পরপর তিন থেকে চার বছর সৌরবিদ্যুতের পেছনে ভর্তুকি হিসেবে ব্যয় করলে সরকার পরবর্তী ২০ বছরের জন্য ভর্তুকি প্রদান থেকে বেঁচে যাবে। পাশাপাশি জাতীয় বিদ্যুৎ তো সাশ্রয় হবেই। বাড়বে সৌরবিদ্যুতের জনপ্রিয়তা। আর তখন সরকার এই ভর্তুকির টাকা বিদ্যুৎ ব্যবস্থতার সম্প্রসারণে ভবিষ্যৎমুখী বিনিয়োগ করতে পারবে। সেনা কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল মোহাম্মদ আলীর এক গবেষণা রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়, ঢাকা মহানগরের ভবনগুলোর ছাদে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বসিয়ে অন্তত ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ভবন মালিকেরা তিন লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে ২৫ বছর মাসিক পাঁচ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। যা আগে বিদ্যুতের বিল হিসেবে দিতে হতো। ঢাকা শহরে তিন লাখ ইউনিট বাড়ি থাকলেও সৌর প্যানেল স্থাপনের মতো রয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার বাড়ি। এখান থেকে মোট ১ হাজার ৪৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। পদ্ধতিগত ক্ষতির পরও কমপক্ষে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান।

সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থায় প্রচুর দেশি বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। উদ্যোক্তাদের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলভিত্তিক যে সৌরবিদ্যুৎ কার্যক্রম চলছে তাতে বছরে এই খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি। ৬০ শতাংশ বিনিয়োগ হয় সৌর প্যানেলেÑযার সবই আমদানিনির্ভর। ২৫ শতাংশ বিনিয়োগ হয় ব্যাটারিতে আর ১৫ শতাংশ আনুষঙ্গিক খুচরা যন্ত্রাংশে। ব্যাটারি ও খুচরা যন্ত্রাংশ দেশেই তৈরি হয়। প্যানেল এখন দেশে তৈরি হচ্ছে। দেশীয় চাহিদা পূরণ করতে পারলে পুরো বিনিয়োগই দেশীয় নির্ভরতায় প্রতিষ্ঠিত হবে। সাশ্রয় হবে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কম মূল্যে সোলার প্যানেল বৃত্তি হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। গ্রামীণ জনপদে সৌরবিদ্যুৎ সম্পর্কিত তথ্য প্রচারণা জরুরি। সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন, প্রয়োগ ক্ষেত্র, ব্যবহার, যন্ত্রপাতি ও সার্ভিসিং, ঋণ সহায়তা, কৃষি ও সেচের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার, কিস্তিতে ক্রয় সুবিধাসহ যাবতীয় সুবিধার বিষয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রচারণার মাধ্যমে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামীণ বাড়িঘর, ছোট-বড় ব্যবসা, হাট-বাজার, হাঁস-মুরগি বা গরু-ছাগলের খামার, মৎস্য খামার, হ্যাচারি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের পরিবর্তে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। ‘সৌরবিদ্যুতের জন্য একবার বিনিয়োগ করুন এবং ২৫ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করুন’Ñএই স্লোগানকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রতিটি স্টেশনের শেডগুলো সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে। সরকার এ বিষয়টি বিশেষভাবে ভাবতে পারে। একই উপায়ে শহর ও উপশহরের বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত এমনকি শিল্প কারখানাতে সৌরবিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনে ভর্তুকি নিশ্চিত করলে এর জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার বাড়বে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুতের জন্য পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠন খুব জরুরি। সবার আগে করণীয়, গ্রামীণ এলাকায় সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার ব্যাপকহারে সম্প্রসারণ সম্ভব হলে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের ওপর চাপ কমে আসবে। গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুতের ব্যবহার যে পরিমাণ কমবে তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। এই বাড়তি বিদ্যুৎ দেশের শিল্প-বাণিজ্যে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করবে। তাই জাতীয় স্বার্থে দেশের অর্থনীতি দ্রুততর বিকাশের জন্য গ্রামীণ জনপদে সৌরবিদ্যুতের ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist