reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৫ আগস্ট, ২০২০

স্মরণ

বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা

ফারহান ইশরাক

জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদের খুব বেশি ভালোবাসি। বাংলার মানুষকে ভালোবেসেই তিনি এ দেশকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছিলেন। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই তাকে এনে দিয়েছিল বিশ্বব্যাপী সম্মান। পৃথিবীর যে স্থানেই বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করা হোক না কেন, এই নামের সঙ্গে সঙ্গে আরো একটি নাম উচ্চারিত হয় মানুষের মুখে। সে নামটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালির জাতির পিতা, রাজনীতির কবি এবং আপামর বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা।

পলাশীর প্রান্তরে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় দীর্ঘদিনের জন্য। অতঃপর প্রায় ২০০ বছরের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে উপমহাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ এ। ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি মিললেও বাংলার জনগণের প্রকৃত মুক্তি এর মাধ্যমে সম্ভব হয়নি। তাই স্বাধীনতা লাভ করেও এক প্রকার পরাধীনতার জালেই আবদ্ধ ছিল এ অঞ্চলের মানুষ। ১৮ শতক, ১৯ শতকে জন্ম নেওয়া অসংখ্য তুখোড় নেতাও পারেননি পলাশীতে হারানো বাংলার স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধার করতে। বরং দিনের পর দিন বেড়েছে বাংলার মানুষের দীর্ঘশ্বাস। অবশেষে বাংলার মানুষ স্বাধীনতা লাভ করে এক তরুণ নেতার হাত ধরে, যিনি জন্ম নিয়েছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া নামের ছোট্ট একটি গ্রামে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। যার হাত ধরেই এসেছিল বাংলার আপামর জনগণের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। আজকের এই স্বাধীন রাষ্ট্রের নামকরণটিও তারই হাত ধরে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশÑ এই শব্দ দুটি বাংলার আপামর জনগণের নিকট সমার্থক। স্বাধীনতার যে দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন ২০০ বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষ দেখে আসছে, সেটির বাস্তব রূপদান সম্ভব হয়েছে এই মানুষটির হাত ধরেই।

একটি দেশের নেতা হতে হলে সে দেশের মাটি ও মানুষের ভাষা জানতে হয়। মানুষের অভিপ্রায় বোঝার ক্ষমতা না থাকলে কখনো জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু মানুষকে বোঝার ও জানার এই কাজটি-ই করেছিলেন সুনিপুণভাবে। তিনি বাংলার মানুষকে ভালোবাসতেন, বুঝতেন এ দেশের জনগণ কী চায়। তাই তার জন্য এ দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দেওয়া যতটা সহজ ছিল, অন্য কারো জন্য এতটা সহজ ছিল না কখনোই। বঙ্গবন্ধু ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। যখনই অন্যায়, দুর্নীতি, মানুষের অধিকার হরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি তিনি হয়েছেন, তখনই করেছেন দুর্বার প্রতিবাদ। টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া সেই প্রতিবাদী তরুণটিই এক দিন শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হয়েছেন, মুক্তির পথ দেখিয়েছেন জাতিকে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে যে কয়েকটি আন্দোলন হয়েছে তার প্রতিটিতেই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বঙ্গবন্ধু। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব খানের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা কিংবা ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান প্রত্যেকটি আন্দোলনে সামনে থেকে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীনতার পথ দেখান তিনি। অবশেষে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা আসে তার কাছ থেকে। তাকে বন্দি হতে হয় পাকিস্তানিদের হাতে। দীর্ঘদিনের কারাবাস শেষে শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। সেসময় বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে তার কারাজীবনের দিনগুলোর কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু ডেভিড ফ্রস্টকে বলেন, ৪ ডিসেম্বর (১৯৭১) ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া খান সব বিচারককে রাওয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠান রায় তৈরি করার জন্য। বিচারক মানে ওই সব কর্নেল ও ব্রিগেডিয়ার। তিনি তাদের বিচারের রায় জানিয়ে দেন এবং সেখানেই তারা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর কারা কক্ষের পাশেই বঙ্গবন্ধুর জন্য কবর খনন করা হয়। নিজেই দেখেছিলেন তার কবর খোঁড়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ভয় নেই, আমি তৈরি আছি। পাক হানাদারদের বঙ্গবন্ধু শুধু একটা অনুরোধ করেছিলেন, মৃত্যুর পর তার লাশটি যেন বাঙালির কাছে দিয়ে দেওয়া হয়। ডেভিড ফ্রস্ট জানতে চাইলেন, ‘আপনি যখন দেখলেন, ওরা কবর খনন করেছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জাগল? আপনার দেশের কথা? না আপনার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের কথা? উত্তরে বঙ্গবন্ধু নিঃসংকোচে বলে দিলেন, ‘আমার প্রথম চিন্তা ছিল আমার দেশ, তারপর আমার পরিবার। আমি আমার জনগণকেই বেশি ভালোবাসি।’

বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনায় সব সময় ছিল াঁর দেশের জনগণের ও বিশ্বের মানুষের উন্নতি ও কল্যাণ। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম মহৎ গুণ ছিল সাধারণ মানুষের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা। তিনি আপাদমস্তক ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ছিল প্রবল। দেশকে তিনি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অবিচল বিশ্বাস। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই তিনি শুরু করেন দেশ পুনর্গঠনের কাজ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, জরাজীর্ণ সরকারি কোষাগার এবং শূন্যমাত্রার বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে তিনি দেখেছিলেন দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশের কৃষি, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসাব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো, অর্থপ্রবাহ, সংবিধান প্রণয়নÑ সবকিছু তিনি নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলেন। আজকের এই বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সরকার কাঠামো, রাষ্ট্রব্যবস্থা যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, তার সবটার ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে তার সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন বিনষ্ট করতে উদ্যত হয় একদল বিশ্বাসঘাতক। তাদের হাতে হয়তো বঙ্গবন্ধুর দৈহিক মৃত্যু ঘটেছে, কিন্তু তার স্বপ্ন এবং চেতনা আজীবন বেঁচে থাকবে এই দেশের মানুষের কাছে। বাংলার মানুষের কাছে তিনি থাকবেন চিরঞ্জীব, চির অমর।

বঙ্গবন্ধু জীবনভর বাংলাদেশের মানুষের জন্য, দেশের সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে গেছেন। তার আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা ও দুঃখ-দুর্দশামুক্ত উন্নত সোনার বাংলা গড়ার। তিনি নিজে স্বপ্ন দেখেছেন, জনগণকে স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছেন। তার সময়ে তিনি ছিলেন বিশ্বের আলোচিত নেতাদের একজন। বাংলাদেশকে সারা পৃথিবীর মানুষ চিনত এই শেখ মুজিব নামটির কারণেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো নেতা এত বেশি জনপ্রিয়তা পাননি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের পাশাপাশি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বও তাকে মানুষের কাছে কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে। তার বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন মানুষকে মুগ্ধ করত। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। তার বজ্রকণ্ঠ উদ্দীপনা তৈরি করত মানুষের মধ্যে। তিনি এসেছিলেন এ দেশের মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না। এই ভালোবাসার জন্যই তিনি নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন, জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন তিনি কারাবরণ করেছিলেন। বারবার শাসকের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু বাংলার মানুষকে তিনি ছেড়ে যাননি। এখনো বাংলার, বাংলার জনগণ আর শোষণ-নিপীড়নমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা প্রতিটি মানুষের প্রেরণার নাম বঙ্গবন্ধু। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের মানচিত্রের অস্তিত্ব মানেই এই ধরণিতে বেঁচে আছেন বঙ্গবন্ধু। এ কারণেই কবি বলেছেন, ‘যত দিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান/তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অস্তিত্ব একই সূত্রে গাথা। এই বাংলার জল, হাওয়া, প্রকৃতির মাঝে তিনি বেঁচে আছেন, তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু।

লেখক : শিক্ষার্থী

ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close