রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২০ জানুয়ারি, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

আতঙ্কের নাম দাবানল

প্রতি বছর লাখ লাখ অর্থের ক্ষতিসহ অনেক প্রাণহানি ঘটে অস্ট্রেলিয়ার বুশফায়ারে। গত বছরের শেষ সপ্তাহেও কয়েকজন মানুষ এ আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। দাবানলে পুড়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার হাজার হাজার হেক্টরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ঘন বনাঞ্চল। মানুষ, পশুপাখি, বসতবাড়ি সবকিছুই ক্ষতির মুখে পড়ে। উদ্ধারকারীরাও সাহায্যে এগিয়ে যেতে গিয়ে আহত, এমনকি মৃত্যুবরণও করেন। কয়েক দিন আগেও নিউ সাউথ ওয়েলস ও ভিক্টোরিয়ার বুশফায়ারে বাবা ও ছেলে নিহত হয়েছেন, নিখোঁজ হয়েছেন আরো কয়েকজন। ভয়াবহ দাবানলে পুড়ছে অস্ট্রেলিয়া। প্রশাসনের ক্রমাগত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দাবানল নিয়ন্ত্রণে আসার বদলে বেড়েই চলেছে। দেশটির দুই অঙ্গরাজ্যে অন্তত ২৫০ বাড়ি পুড়ে গেছে। এরমধ্যে ভিক্টোরিয়া রাজ্যে ৪৩টি ও নিউ সাউথ ওয়েলসে ২০০ বাড়ি পুড়ে গেছে বলে বিবিসি অনলাইন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। দুই মাসের বেশি ধরে চলা এই দাবানলে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৮ জন মানুষ। এদিকে দেশটির প্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দাবানলে বন্যপ্রাণীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, মারা গেছে প্রায় ৫০ কোটি প্রাণী। ইউনিভার্সিটি অব সিডনির প্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানান, দাবানলে সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৪৮ কোটি স্তন্যপায়ী, পাখি ও সরীসৃপ মারা গেছে। প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দাবানলে পুড়ে ছাই হয়েছে গেছে হাজার হাজার কোয়ালা। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা এ প্রাণীর বেশির ভাগই বাস করত অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের মধ্য-দক্ষিণ উপকূলবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় আট হাজার কোয়ালা মারা গেছে এ দাবানলে, যা এ অঞ্চলের কোয়ালা জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ।

প্রতি বছর দেশটিতে কমবেশি ৫৪ হাজার দাবানলের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকান্ডের এসব ঘটনায় দেশটির কয়েকটি অঞ্চল বিপর্যস্ত। তবে বিস্ময়কর তথ্য হলো, দাবানলের অনেক ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার মানুষের কারণে ঘটে। এসব মানুষ ইচ্ছা করেই এই আগুন লাগান। তা হতে পারে মনের ভেতর জ্বলতে থাকা কোনো আগুন থেকে কিংবা এর পেছনে কোনো কারণ না-ও থাকতে পারে। সম্প্রতি এ-বিষয়ক দুটি সমীক্ষার তথ্য উল্লেখ করে বিবিসি বলছে, অস্ট্রেলিয়ায় যে ৫৪ হাজার দাবানলের ঘটনা ঘটে, এর মধ্যে ১৩ শতাংশই স্বেচ্ছায় লাগানো আগুন। ৩৭ শতাংশ ঘটনা ‘সন্দেহজনক’ বলে বিবেচিত। অবশ্য অস্ট্রেলিয়াস ন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ এই বুশফায়ার অ্যান্ড আরসনের উপপরিচালক পল রেডের মতে, প্রতি বছর প্রায় ৬২ হাজার দাবানলের ঘটনা ঘটে এবং দিন দিন তা আরো বেড়ে চলেছে। তবে সংখ্যা যা-ই হোক, প্রশ্ন হলো, কেন দাবানলের মতো বিধ্বংসী ঘটনা মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে করে? পল রেড বলছেন, অস্ট্রেলিয়ায় ইচ্ছাকৃতভাবে লাগানো দাবানালের অর্ধেকেরও বেশি ঘটে থাকে ২১ বছরের নিচে বয়সিদের মাধ্যমে। এই দলের মধ্যে থাকে সেই শিশুরা, যারা প্রথমে আগুন নিয়ে খেলা শুরু করে, পরে আর তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে না।

অন্যদিকে, মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত কিছু শিশু-কিশোরের মাধ্যমেও এ ঘটনা ঘটে থাকে। তবে শিশু-কিশোরদের থেকেও বড় বয়সিদের আগুন লাগানোর পেছনের কারণগুলো আরো বেশি বিস্ময়কর। পল রেড বলেন, ২৮ বছরেরও বেশি বয়সি একদল অস্ট্রেলীয় আছেন, যারা আগুন লাগানোর মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যাকে বলা হয় ‘সাইকো-সেক্সুয়াল ফ্যাসিনেশন’। রেডের মতে, এসব মানুষ কোনো কার্যকারণ ছাড়াই কোনো আগুন লাগায়। অন্তত পরিসংখ্যান তা-ই বলে। বরং ২৮ বছরের নিচে একদল ও ৩০ বছরের ওপরে একদল মানুষ বেশি আগুন লাগিয়ে থাকেন। এই দুই দলের লোকেরা দাবানলের মৌসুমে আগুন লাগানোর কাজ করে থাকেন। কারণ এ সময় লাগানো আগুনের উৎস খুঁজে পাওয়াটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকে চাকরিচ্যুত বা প্রেমে ব্যর্থ হয়েও দাবানলের ঘটনা ঘটান। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের এক পুলিশ কর্মকর্তা ১৬ বছর বয়সি এক ছেলেকে আগুন লাগানোর দায়ে আটক করেন। এরপর ওই পুলিশ অফিসার দুঃখ করে বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই অনেক ভগ্নহৃদয়ের মানুষ দাবানল ছড়িয়ে দিচ্ছে। অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যম এবিবিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এক ব্যক্তি জানিয়েছিলেন, প্রেমিকা অন্যের সঙ্গে কথা বলছে দেখে রাগে তিনি দাবানলের ঘটনা ঘটান। পল রেড বলেন, মাঝেমধ্যে প্রান্তিক মানুষ সমাজের ওপর ক্ষোভ ঝাড়তে দাবানল ছড়িয়ে থাকেন। তবে রেডের মতে, কিছু লোক আছে যারা আগুন লাগায় শুধুই মনের আনন্দে। তিনি বলেন, চোখের সামনে টকটকে লাল আগুন সবকিছু পুড়িয়ে দিচ্ছে, এটা দেখেই তারা প্রকৃত অর্থেই সুখ পায়।

এই দাবানলের কারণে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সময় লাগছে বলে জানিয়েছেন দমকল কর্মীরা। ভয়াবহ দাবানল উপকূলের দিকে ধেয়ে আসায় এলাকাগুলোর আতঙ্কিত হাজারও বাসিন্দা ও পর্যটক জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন সমুদ্রে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সামরিক বাহিনীর সাহায্য চাওয়া হয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের সহায়তাও চেয়েছে কর্তৃপক্ষ। অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলে গেল চার মাসে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। ১ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুড়ে গেছে ৫০ লাখ হেক্টর বনভূমি। অস্ট্রেলিয়ায় ভয়াবহ দাবানলে এখন পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া চারজন পর্যটক নিখোঁজ রয়েছেন। আগুনের কারণে দেশটির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত মৃত্যুর সর্বমোট কোনো পরিসংখ্যান দেয়নি। অস্ট্রেলিয়াজুড়ে দাবানল থামার তো কোনো লক্ষণই নেই বরং প্রতিদিন বাড়ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, আগুনের তাপে দেশটির আকাশ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। নিউ সাউথ ওয়েলসে শত শত মানুষ গৃহহীন হয়ে ও আগুনের তাপ থেকে বাঁচতে সমুদ্রের ধারে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘরবাড়ি সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। স্থানীয়রা বলেন, লাল হয়ে ওঠার আকাশের নিচে নৌকায় বা উপকূলে তাঁবু বানিয়ে বসবাসের অভিজ্ঞতা ভয়ানক। দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার মালাকুটা অঞ্চলে একটি সমুদ্রসৈকতে প্রায় চার হাজার মানুষের আটকে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, পুরো অঞ্চলই দাবানলের কবলে চলে যাওয়ার ফলে প্রাণ বাঁচাতে এলাকার মানুষ সমুদ্রের ধারে আশ্রয় নিয়েছে।

এ ছাড়া আগুনের বলয় ক্রমশ ধেয়ে আসছে সৈকতের দিকে। কিন্তু সমুদ্রসৈকত থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা খোলা নেই। এ অবস্থায় নৌকা এবং বিমানে করে সেখানে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। গোটা অঞ্চল ঘিরে রেখেছেন দমকলকর্মীরা। নিউ সাউথ ওয়েলস অঞ্চলে আগুনের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে এক দমকল কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দাবানলের মধ্যেই আচমকা ওই অঞ্চলে শুরু হয় টর্নেডো। আগুনের গোলাসমেত সেই টর্নেডো আস্ত একটা দমকলকে হাওয়ায় তুলে নেয়। সেই গাড়ির ভেতরেই ছিলেন একজন কর্মী। ঘটনাস্থলেই ঝলসে মৃত্যু হয় তার। মালাকুটার সাম্প্রতিক অবস্থা আরো আশঙ্কাজনক। বেশ কিছু পর্যটক আগুন থেকে বাঁচতে সমুদ্রসৈকতে আটকে পড়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, চারজন পর্যটকের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আটকে পড়া সাধারণ মানুষদের ভয় না পাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে প্রশাসন। অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গলে গ্রীষ্মকালে দাবদাহের কারণে দাবানল দেখা যায়। স্থানীয়রা একে বলে থাকে বুশফায়ার। মাঝে মাঝেই মারাত্মক আকার ধারণ করে এটি। আগুনের রোষের মুখে অসহায় হয়ে পড়ে মানুষ। সম্প্রতি দেশটির নিউ সাউথ ওয়েলস ও ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যে এক ডজনেরও বেশি দাবানল ৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এই দাবানলকে জরুরি মাত্রা বলে ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। আগুন থেকে বাঁচতে উপকূলে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জন্য খাবার ও পানি সরবরাহের জন্য নৌবাহিনীর জাহাজ মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে ভিক্টোরিয়া রাজ্য প্রশাসন। তবু দাবানল থামছেই না।

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া দাবানল এখন পর্যন্ত চলছেই। দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানলে পুরো দেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি রাজ্যেই দাবানল আঘাত হেনেছে, তবে নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত কয়েক দিনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও তীব্র বাতাসের কারণে নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে দাবানল অবস্থার অবনতি হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত রাজ্যের অন্তত ১১২ স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে অন্তত আড়াই হাজার দমকল কর্মী নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ জানিয়েছে, স্থানীয় সময় বিকালে দক্ষিণ উপকূল থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সতর্ক করা সত্ত্বেও নিরাপদ স্থানে না গিয়ে বাড়িতে অবস্থান করায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে দাবানলের আগুনে চারজন মারা যান। রাজ্যে গত জুলাই থেকে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩৬ লাখ হেক্টর জমি পুড়ে গেছে। তাছাড়া অন্তত ৯০০ বাড়ি আগুনে ধংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এদিকে ভিক্টোরিয়া রাজ্যেও দাবানলের তীব্রতা বাড়ছে। রাজ্যের মালাকুটা উপকূলে অন্তত চার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তারা নৌকায় কিংবা সমুদ্রসৈকতে তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিযাপন করছে। এই রাজ্যে অন্তত তিনজন নিখোঁজ রয়েছে। দেশটির আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, আগামী দুই থেকে তিন দিনের তাপমাত্রা কমে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। তবে আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ তাপমাত্রা বেড়ে পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। দেশটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দমকল বাহিনী আগুন নেভাতে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close