সতীর্থ রহমান

  ১৯ জানুয়ারি, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

শীতের মৌসুমে শীতার্ত মানুষ

বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এখন শীতের প্রচন্ড দাপট শুরু হয়েছে। প্রকৃতিতে এখন হিমশীতল বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। শীতে কাঁপছে গোটা দেশ। দেশজুড়ে বইছে হিমেল হাওয়া, ঘন কুয়াশা, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর শৈত্যপ্রবাহ। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কমে আসছে তাপমাত্রা। তাপমাত্রা দ্রুত নেমে আসায় শীতের ছোবলে জনজীবনে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। হাড় কাঁপানো শীত আর অব্যাহত শৈত্যপ্রবাহে থমকে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। দিনে কুয়াশার চাদরে ঢাকা সূর্য, রাতে হালকা বৃষ্টির মতো কুয়াশাপাত ও শৈত্যপ্রবাহে মানুষ, পশু-পাখি ও অন্য প্রাণিকুল জড়সড় হয়ে গেছে। সারা দিন সূর্যের মুখ দেখা পাওয়া ভার। দিনভর আকাশ ঘনকুয়াশায় ঢাকা থাকায় সকাল-সন্ধ্যার পার্থক্য নির্ণয় করাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। এক টুকরো রোদের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে শীতকাতর মানুষ। শীতের শুভ্রতায় ছেয়ে গেছে সব প্রকৃতি। কনকনে হিমেল হাওয়া ও ঘন কুয়াশার সঙ্গে প্রবাহিত হচ্ছে শীতবৃষ্টি। পানির মতো ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে শিশির বিন্দু। পথঘাট, মাঠ-প্রান্তর, গাছপালা ভিজে একাকার হয়ে গেছে। শিশির সিক্ত গাছগুলো দেখে মনে হয় যেন গোছল করেছে। শীতল বাতাসের ঝাঁপটায় চোখ দিয়ে পানি ঝরে। একটা উদাস সুর বাজে প্রকৃতিতে। শীতের প্রকৃতিকে মনে হয় ঝিমিয়ে পড়া প্রকৃতি।

ইউএনডিপির এক তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৬ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এদের ৪০ শতাংশের নেই কোনো শীতবস্ত্র, ৩০ শতাংশের নেই দুটি জামা, ৯৬ শতাংশের নেই থাকার নিজস্ব ঘর। ভূমিহীন, ক্ষেতমজুর, ছিন্নমূল, বস্তিবাসী, ভবঘুরে, ভাসমান খোলা আকাশের নিচে বসবাসরত প্রায় ১৫ লাখ পরিবার শীতবস্ত্রের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কনকনে শীত আর হিমেল হাওয়ার ছোঁয়ায় হতদরিদ্র, ছিন্নমূল, দুস্থ, ভবঘুরে, অভাবী, প্রতিবন্ধী ও পথশিশুদের দুঃখ কষ্টের সীমা নেই। আর্থিক দুরবস্থার কারণে অনেকেই শীতের গরম কাপড় কিনতে পারছেন না। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র না থাকায় তারা চরম মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। অসহায় শীতার্ত মানুষ কাগজ, পাতা ও খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। প্রচন্ড শীতের কারণে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ কাজ করতে না পারায় আয় রোজগার কমে গেছে। অনাহারে অর্ধাহারে অতিকষ্টে জীবন কাটাচ্ছে। বৈরী শীতের কারণে কৃষিকাজসহ দৈনন্দিন কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অফিস-আদালত,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বিমা, হাট-বাজার, রাস্তাঘাট, মোড় ও খেলার মাঠে মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে। মানুষ বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। লেপ-কাঁথা-কম্বল জড়িয়ে মানুষ গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে। হাড় কাঁপানো শীতের চোটে মানুষ গোছল করতে ভয় পাচ্ছে। কনকনে শীতের কারণে শরীর সহজে গরম হচ্ছে না। হাত-পা হিম হয়ে আসছে। দুর্বিষহ শীতের ছোবলে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ, ছিন্নমূল, দরিদ্র জনগোষ্ঠী। শীতের মরণ কামড়ে বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। শীতার্ত জনগণ শীত নিবারণের আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শীতের হিংস্র ছোবলে মানুষের এখন ত্রাহি অবস্থা। রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশার কারণে কনকনে হিমেল হাওয়ায় অসুস্থ হয়ে মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। মৃতের সংখা বাড়ছে। শীতকালীন ভাইরাসজনিত সর্দিকাশি, গলাব্যথা, জ্বর, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কোল্ড ডায়রিয়া, রক্ত আমাশয়, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, মেনিনজাইটিস প্রভৃতি রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন।

হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, কবুতর প্রভৃতি গৃহপালিত পশুপাখি শীতের প্রকোপে কাহিল হয়ে পড়েছে। শীতের হাত থেকে রক্ষার জন্য কৃষকরা গরু-ছাগলের গায়ে বস্তা/চট, কাপড় জড়িয়ে রাখছেন। মাত্রাতিরিক্ত শীত ও লাগাতার ঘন কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে আলু, শাকসবজি ও ইরি-বোরো ধানের বীজতলা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বীজ সহজে অঙ্গুরোদগম হচ্ছে না। কোল্ড ইনজুরি ও ছত্রাকে আক্রান্ত বীজতলার কচি চারাগুলো প্রথমে হলুদ ও পরে তামাটে বর্ণ ধারণ করছে। অনেকে ওষুধ ছিটিয়েও রক্ষা করতে পারছেন না বীজতলা। আলুখেতে মড়ক লেগেছে। ঘন কুয়াশায় আলুর পাতা কুঁচকে ফ্যাকাশে হলুদ দাগ দেখা দিয়েছে। প্রতিকূল ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে চাষাবাদে মন্দাভাব চলছে। বাংলাদেশে সাধারণত তিন মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ হয়। তাপমাত্রা ১০ থেকে ৮ ডিগ্রি হলে শৈত্যপ্রবাহটি হয় মৃদু, ৮ থেকে ৬ ডিগ্রি হলে মাঝারি এবং ৬ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয়।

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। কনকনে হিমেল হাওয়া, ঝড়-বৃষ্টি ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেক বেলা হওয়া সত্ত্বেও বহু স্কুলে তালা ঝুলতে দেখা যায়। অনেক সময় ছাত্রশূন্য স্কুলে শিক্ষকদের গালগল্প করে সময় কাটাতে হয়। বর্তমানে গুটিকয়েক শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলগুলো চলছে ঢিলেঢালাভাবে। শীতকবলিত দুর্গত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা দরকার। প্রাথমিক স্তরে প্রায় মাসব্যাপী গ্রীষ্মকালীন অবকাশ থাকলেও শীতকালীন অবকাশ বলতে গেলে অনুপস্থিত। শীতের আগেই শেষ হয়ে যায় নামমাত্র শীতকালীন ছুটি। প্রতি বছর মধ্য ডিসেম্বর থেকে পুরো জানুয়ারি মাস (৪৫ দিন) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত শীতকালীন ছুটির সময় পাঠদান কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রেখে সীমিত পরিসরে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু রাখা যেতে পারে। বাংলাদেশে শীত এখন একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রতি বছর শীত দুর্যোগ আকার ধারণ করে। শীতকবলিত দুর্গত এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে শীতবস্ত্র এবং ত্রাণসামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম জোরদার করা উচিত। মানবিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অভাবী মানুষের শীতবস্ত্রের অভাব মোচনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিত্তবান, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক সকলকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। সম্মিলিত উদ্যোগ আর প্রচেষ্টায় পরিত্রাণ পেতে পারে অগণিত শীতার্ত প্রাণ। আপনার ফেলে রাখা অব্যবহৃত কাপড়টি আপনার মতোই একজন মানুষকে বাঁচাতে পারে শীতের প্রকোপ থেকে। আসুন, আমরা শীতার্ত মানুষের জন্য সাহায্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করি।

লেখক : সহকারী শিক্ষক

নুনসাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

রতিনাথপুর, দিনাজপুর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close