জাকির আজাদ

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২০

মুক্তমত

শিশুর ব্যক্তিজীবন

আজও অনন্যার পাড়ার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বাড়ির ছাদে পিকনিক করা হলো না। কারণ স্কুলের হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করা হলেও কোচিং সেন্টারের আগাম হোমওয়ার্কগুলো শেষ হয়নি। তাই মায়ের কড়া নির্দেশ হোমওয়ার্ক শেষ করতেই হবে। কোনোরূপ খেলাধুলা বা পিকনিক করা চলবে না। অগত্যা নুপার এই ভরদুপুরে নিজের ঘরে বসে সেই কাজটিই করছে, তবে তাতে মনোযোগ রাখতে পারছে না। বারবার ভুল এসে যাচ্ছে। বাবার কাছেও সে পিকনিকের বায়নাটি করেছিল, বাবারও সেই একই হুকুম। নুপার ভালো লাগে না এত চাপাচাপি। একসময় সে বাথরুমের ভেতর ঢুকে কান্না করে। নিজের মনের ইচ্ছার মৃত্যুতে তার শোক থাকে দীর্ঘক্ষণ। যার ফলে মোটেই খেতে ইচ্ছা করে না। হয়তো দেখা যায়, তার অনেক প্রিয় খাবার সামনে এসে গেছে, তবু তার খেতে ইচ্ছা করে না একটুও।

বর্তমান সময়ে সন্তানকে দেশের একজন তৈরি করতে সব বাবা-মাই ব্যতিব্যস্ত। যার ফলে শৈশব থেকেই শিশুদের ওপর একের পর এক বোঝা চাপানো হয়। যা তারা ধারণ করতে পারুক আর না পারুক, সেদিকে না খেয়াল রেখে শিশু মনটাকে পরিণত করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। যার প্রভাবটা শিশুর ওপর কীভাবে পড়বে, তা অনেক অভিভাবকই ওয়াকিবহাল নন। ফলে তাল ও লয় ধরে রাখতে না পেরে কিংবা অনবরত হোঁচট খেতে খেতে অনেক শিশু ও কিশোর-কিশোরী আত্মহননের কাজটি করে বসে। যা কি না এখন একটি সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিক দিক থেকে যারা সচ্ছল এ সমস্যা তাদের সমাজেই বেশি। হালফিল অনেক বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের ‘টেলার মেড ফিউচারের’ প্রতি ছুটিয়ে নিয়ে চলছে। যেন শিশু একটি তেল-গ্যাস চালিত গাড়ি বাবা-মা তার চালক। তাদের ইচ্ছায় চালিত গাড়িটি চলতে হবে। যা ফলে এখনকার অনেক শিশুই ব্যক্তিজীবনে বড় অসহায়। যে অসহায়ত্ব বা নির্যাতন অনেক শিশু সহ্য করতে না পেরে নিজেকে হত্যা করে ফেলে। অথবা স্বগৃহ থেকে পালিয়ে অন্ধকার জীবনে ঢুকে পড়ে। আবার কেউ কেউ বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ভারসাম্য খুইয়ে সৃষ্টি করে নানাবিধ সমস্যা।

প্রত্যেকটি শিশুই জন্মায় তার কিছু নিজস্বতা নিয়ে। সবার স্মৃতিশক্তি ধারণক্ষমতা একই মাত্রায় হয় না। গ্রহণ করার ক্ষমতাও এক থাকে না। অনেক অভিভাবক তাদের শিশুদের জন্য অনেক চিন্তাভাবনা করেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে খাদ্যতালিকা ধরে শিশুকে নিয়মিত খাওয়ান। কোন বয়সে কখন কী ধরনের পোশাক পরানো দরকার, তা নিয়ে বেশ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন। সেই সঙ্গে শিশুর মানসিক এবং দৈহিক উন্মেষের জন্য চালান নানা রকম প্রচেষ্টা। এমনকি প্রতিবেশীদের সঙ্গে পাল্লায়ও নেমে পড়েন। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বাবা-মারা নিজেই সন্তানের ভবিষ্যতটি কীভাবে গড়ে তুলতে হবে, তা ছকে বেঁধে নেন। শিশুটি জন্মের পর থেকে শুরু হয় সে কী হবে; ডাক্তার, না ইঞ্জিনিয়ার ব্যারিস্টার তার ছক গণনা। জন্মের পর বছর ঘুরতেই ছক ধরে শুরু হয় তার শিশুশিক্ষা। অথচ শিশুর নিজেরও তো একটি প্রত্যয় থাকে। সেই প্রত্যয়ের সঙ্গে তার ওপর আরোপিত ব্যবস্থাবলির শুরু হয় সংঘাত। সেই সংঘাত অনেক শিশু সহ্য করতে পারে না। যার কারণে জীবনে নেমে আসে বিপত্তি।

১৯৯০ সালের ২ সেপ্টেম্বর শিশুর মেধা ও মননের বিকাশে এবং তাদের অধিকার বাস্তবায়নে জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ পাস করা হয়। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে ওই সনদ বাস্তবায়ন বাধ্যমূলক করা হয়েছে। সনদের ২৮ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সব শিশুরই শিক্ষার অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হলো সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা এবং বিনা খরচে শিক্ষা-সুবিধা নিশ্চিত করা।’ আবার সনদের ৩৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘কোনো শিশুই নির্যাতন বা নৃশংস অমানবিক মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির শিকার হবে না’।

আজ থেকে ৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের শিশুদের জীবনধারা ছিল অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। প্রতিটি শিশুরই তখন থাকত নিজস্ব একটি জগৎ। নিজেদের মধ্যে নানা ধরনের খুনসুটি চলত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার সমাধানের প্রয়োজনে অভিভাবকদের প্রয়োজন হতো না। পরিবেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠত স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আমবাগান এবং বনজঙ্গলে অদিগন্ত প্রান্তরে লুকোচুরি খেলা, নদী বা পুকুরে, হাওর-বিলে মাছ ধরা। কলার ভেলা তৈরি করা, সাঁতার কাটা, মাটির খেলাঘর তৈরি, পাখির বাসায় হানা দেওয়া কত কি না করত তারা। শিশুরা নিজেদের নিয়ে তৈরি করত ছোট ছোট সমাজ। সেই সমাজে তাদের নিজস্ব ব্যক্তিচিন্তার মুখ্য হয়ে ওঠে। তাদের নিজস্বতাকে প্রকাশিত করার সুযোগ পেত অবলীলায়। সেখানে অনুপ্রবেশ ঘটত না অভিভাবকদের। অথচ এখন এসবের একান্তই অভাব। যার বিপরীতে প্রতি মুহূর্তেই শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা। সে ভবিষ্যৎ বলতে মুখ্যত অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। বেশির ভাগ বাবা-মার ইচ্ছা তার সন্তান সমাজের হোমরা-চোমরা তৈরি হোক। ফলে শিশু বয়সেই শুরু হয় ‘প্রফেসনালিজম’ বা পেশাভিক্তিক জীবন প্রণালি। শিশুর স্বাস্থ্য, মানসিক ক্ষমতা, মানসিক প্রবণতা থাকে উপেক্ষিত।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মনোবিজ্ঞানী বিভাগের অধ্যাপক এস এস মবিন বলেন, পারিবারিক গন্ডি পেরিয়ে শিশুরা যখন স্কুলে প্রবেশ করে, তখন সে এক ভিন্ন পরিবেশে গিয়ে পড়ে এবং অনেক নেতিবাচক পরিস্থিতির শিকার হয়; যা কি না শিশুদের সব ক্ষেত্রে তা প্রভাব পড়ে। তাই সে জোর করে চাপানো কোনো কিছুই মানতে পারে না। ফলে সে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে। এমনি দৈহিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই তার মন ও ইচ্ছাটাকে বুঝতে হবে।

জন্মের পর থেকেই অনেক পরিবারে শিশুর কোনো ব্যক্তিস্বাধীনতা বা নিজস্ব আশা-আকাক্সক্ষা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। যারা আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল এবং তথাকথিত আধুনিকতার শিকার। সব সময় কেউ না কেউ তাদের খবরদারি করছে। কখনো বাবা-মা ও অভিভাবক। শিশুর নাওয়া-খাওয়া সাজ-পোশাক চালচালন সব যেন নির্ভর করে বড়দের খেয়ালের ওপর। ছোট বয়স থেকে তাদের সামনে তুলে ধরেন একটি মাপাজোখা জীবনপ্রণালি। যার কারণে শিশুরা সমাজের বহুমুখী জগৎ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। যে অজ্ঞতার কারণে তাদের জীবনে এনে দেয় নানা সমস্যা।

আবার অনেক অভিভাবক অনেক সময় শিশুদের ওপর লেখাপড়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। অন্য কারো তুল না দিয়ে তিরস্কার করেন। এসব শুনে শৈশব থেকে কৈশোর থেকেই শিশুর জীবনে গড়ে উঠে নৈরাশ্যজনক ব্যক্তিত্ব। শিশুরা ক্রমে ক্রমে স্বকীয় থেকে আস্থা হারাতে থাকে। এক সময় হয়তো মানসিক রোগী হয়ে যায়। শিশুদের যে ভালোমন্দ বোঝার মতো ক্ষমতা আছেÑ এ কথা অনেক পরিবারের অভিভাবক মানতেই চান না। তাদের ওপর তারা চাপিয়ে দেন এমন অনেক ধারণা এবং অনুশাসন; যা শিশুর নিজস্ব ব্যক্তিত্বকে সাবলীলভাবে বিকশিত হতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অনেক সময় বাবা-মা এবং অভিভাবকদের আচরণ, আশা-আকাক্সক্ষা ও শিশুদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এবং বাবা-মা এবং সন্তানের মধ্যে এমন অবস্থায় আর সম্মানজনক সম্পর্ক থাকে না। বরং পরিবারে কখনো সামাজিক ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি করে। শিশুদের ব্যক্তিজীবন যাতে সুন্দর এবং সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হয়, সেদিকে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে।

লেখক : সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close