মীর আবদুল আলীম

  ১৮ নভেম্বর, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

জীবন এবং নগ্ন বাস্তবতা

সন্তান হিসেবে মাকে নিয়ে লেখার দায় বোধ করছি। লেখক হিসেবে এটা দায়িত্বও। কেবল মাকে নিয়েই লিখব তা কি করে হয়? এ দেশে হতভাগা বাবাদের গল্পও যে অনেক আছে। এমন কিছু ঘটনায় চোখে জল আসে; হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। জীবনের গল্প তো এমনই হয়। এ জাতীয় ঘটনার সঙ্গে আমরা মোটেও নতুনভাবে পরিচিত নই। কি সেই ঘটনা? পত্রিকায় প্রকাশিত এমন সংবাদের একটি ‘বাসস্ট্যান্ডে ফেলে রাখা বৃদ্ধ মায়ের ছেলের জন্য অপেক্ষায় কাটল এক মাস’। অন্যটি ‘ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করা অসুস্থ বৃদ্ধ বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে প্রেরণ’। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ দুটি আমাদের বিবেক, মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধন এবং আত্মার সম্পর্কবিষয়ক এতদিনকার ধ্যান ধারণার ওপর প্রচ- আঘাত হানে। সংবাদ দুটি সমাজের এক নগ্ন বাস্তবতাকে উন্মোচন করে।

আজকাল বৃদ্ধাশ্রমের সঙ্গে বেশ পরিচিত আমরা। এক দশক আগেও অধিকাংশ বাঙালির মাঝে বৃদ্ধাশ্রমের তেমন ধারণা ছিল না। এখন দেশের অনেক জায়গায়ই বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। আর নরক নামীয় এ বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় হচ্ছে অনেক বৃদ্ধ মা-বাবার। সেখানে যেতে তাদের বাধ্য করা হয়। অনেকে আবার জন্মদাতা মা-বাবার জন্য অতটুকু ভদ্রতাও দেখান না। ওরা জন্মদাত্রীকে ফেলে আসেন রাস্তাঘাটে, নর্দমায়!

সমাজ, রাষ্ট্র এবং পরিবারের আপরাপর স্বজনদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। এ নিয়ে আন্দোলনও হতে পারে। পরিবারের লোকজন এ আন্দোলনে শামিল হবেন, প্রতিবেশীরা যোগ দেবেন। রাষ্ট্রেরও এ ব্যাপারে দায় আছে। রাষ্ট্র এমন অমানবিক বিষয়টিকে আইনের আওতায় আনতে পারে। নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে এমন কু-সন্তানদের তাৎক্ষণিক সাজার বিধান করতে পারে। বিষয়গুলো জনসমক্ষে নিয়ে আসা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কর্তব্য আছে। মোদ্দাকথা হলো সবাইকে সবার জায়গা থেকে ওদের বিরুদ্ধে আওয়াজ, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়তে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় নিজেরা ভালো হয়ে গেলে। ভাবনায় আনতে হবে আমরা আমাদের মা-বাবার কারণেই পৃথিবীতে আসতে পেরেছি। তারাই আমাদের আলোর মুখ দেখিয়েছেন। তারাই আমাদের আগুন, পানি, রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছেন। মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন; যদিও আমরা অনেকে মানুষ না হয়ে অমানুষেই হয়েছি। মা-বাবার কষ্টের কথা বেমালুম ভুলে গেছি। চরম অসহায় সময় তারা যখন পার করছেন তখন তাদের পাশে আমরা আর নেই। এমন অমানবিকতার পথটি সব নাগরিকের পরিহার না করা চরম মানবতার পরিপন্থি। হাল জামানায় সন্তানদের প্রতি মা-বাবার অধিকার বিষয়ে সচেতনতা খুবই দরকার। মা-বাবা আর সন্তানের সম্পর্কে ঘাটতি হলেই পরিবারের শান্তি আনয়ন মুশকিল হয়ে পড়ে। তবে একথাও সত্য পাশ্চাত্যের মতো আমাদের দেশেও মা-বাবা-সন্তান সম্পর্কে কোথাও কোথাও ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করেছে। সে কারণে দেশে এখন দিন দিনই বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা। সে সংখ্যা যে অদূর ভবিষ্যতে ফুলে ফেপে আরো মস্তবড় হবে নাÑ সেটাইবা কে বলতে পারে? কিন্তু তা হতে দেওয়া ঠিক হবে না। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতেই হবে।

আরেকটি জীবনের গল্প দিয়ে লেখা শেষ করব। ‘বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানের কাছে মায়ের চিঠি’ ফেসবুকে এ শিরোনাম একটি লেখার মন্তব্য আমি এভাবে লিখেছিলাম, ‘এই ছেলে তোকে কি বলে ডাকি বলতো? কুকুর, বিড়াল? না এ নামে তোকে ডাকলে পশুজাতির যে আর মান ইজ্জত রইবে না। ডাকাডাকি বাদ দিই। বরং তোর মায়ের মতোই তোর জন্য দোয়া করি- ‘তুই বেঁচে থাক বছরের পর বছর অনন্তকাল’। খোদার কাছে প্রার্থনা এই যে, তিনি যেন তোর অমানুষী মনে উপলব্ধি সৃষ্টি না করে তোর কাছে আজরাাইল না পাঠান। চিঠি পড়ে তোর মায়ের কষ্ট আমি পুরোটা উপলব্ধি করতে পারছি না। এত বেশি কষ্ট উপলব্ধি করি কি করে? তোর জন্য ফরিয়াদ করি, খোদা যেন তোকে তোর মায়ের মতো সমকষ্ট দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করান। এর বেশি কষ্ট তোর জন্য বোধ করি প্রয়োজন পড়বে না। তোর মা কষ্ট যেমনটা পেয়েছেন ঠিক তেমন কষ্টই তোকে দিক খোদা। ভালো থাকিস... ’। ফেসবুকে আমার এ মন্তব্যের পর এর সমর্থনে শতাধিক মন্তব্য পেয়েছি যা পড়লে অনেকেরই চোখে জল আসবে।

বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো ওই মা তার ছেলেকে লিখেছেনÑ ‘খোকা তুই কেমন আছিসরে? বউমা আর আমাদের ছোট দাদুভাই সবাই ভালো আছে তো? জানি তোদের তিনজনের ছোট সংসারে প্রত্যেকেরই খুব কাজ। তবুও তোদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ। একদিন একটু সময় করে এই বুড়ি মাকে দেখতে আয় না! কিরে, আসবি না? ওঃ বুঝতে পেরেছি! এখনো আমার ওপর থেকে অভিমান যায়নি বুঝি! আমাকে যেদিন বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলি, সেদিন ঝগড়া করেছিলাম বৃদ্ধাশ্রম থেকে আমাকে নিতে আসা লোকজনদের সঙ্গে। জানি শেষ দিনটাতে একটু বেশি রকমেরই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম, তাছাড়া আর কিইবা আমি করব বল, সময়মতো ওরা এসে আমার জিনিসপত্র সব জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নিল, তারপর বারবার তাগাদা দিতে লাগল। বাবা কারণ আমি তোর সঙ্গে দেখা করে আসার জন্য তাদের কাছে সময় চেয়েছিলাম, তারা সময় দিলেও শেষ পর্র্যন্ত তুই আসিসনি। তুই কাজে এত ব্যস্ত থাকিস তখন আমার মনে ছিল না। পরে মনে পড়েছিল, তাই তোর সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছি। তুই রাগ করিসনি তো? আর সেদিন আমার সেই জেদ দেখে বউমা তো রেগেই আগুন। তাছাড়া তার তো রাগবারই কথা! আমাকে নিয়ে যেতে যারা এসেছিল, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা যা তড়িঘড়ি শুরু করে দিল। তা দেখবার জন্য পাশের বাড়ি থেকে কেউ কেউ উঁকি দিতে লাগল। এতে বউমার একটু লজ্জাবোধ হবেই। সেদিন তোদের যে অপমান করে এসেছি তোরা সেসব ভুলে যাস কেমন করে! আমার কথা ভাবিস না। আমি খুব ভালো আছি! আর কেনই-বা ভালো থাকব না বল? তোরা তো আমার ভালো থাকবারই বন্দোবস্ত করে দিয়েছিস। তবে একটা কথা, আমার কথা যদি তোর কখনো-কোনো দিন মনে পড়ে; তখন যেন নিজেকে তুই শেষ করে দিস না। তুই এখনো ১০০ বছর বেঁচে থাক।’

বৃদ্ধ মা-বাবা আর বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে লিখব আর নচিকেতার সেই গান গুন গুন করে গাইব না তা কি করে হয়? ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার/মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার/নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি/ছেলে আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’

‘আপনার চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম।’ কঠিন এক সত্য। আর এ সত্যকে মেনেই অনেক বৃদ্ধ মা-বাবা আশ্রয় নেন বৃদ্ধাশ্রমে। সন্তানের কাছে যাদের বেশি কিছু চাওয়ার নেই; শেষ বয়সে আদরের সন্তানের পাশে থেকে সুখ-দুঃখ ভাগ করবার ইচ্ছা এতটুকুই যা চাওয়ার। আর এ নিয়েই প্রতিটি মা-বাবা প্রহর গুনতে থাকেন দিবা-রজনী। কিন্তু অনেকেরই সেই সন্তানের কাছে আশ্রয় না হয়ে; আশ্রয় হয় আপনজনহীন বৃদ্ধাশ্রমে। শেষ বয়সে মস্ত ফ্লাটের কোনো জনমদুঃখী মা-বাবার এতটুকুও জায়গা মিলে না। ওদের ছুঁড়ে দেওয়া হয় প্রবীণ নিবাস নামীয় নরকে। তবুও প্রতিবাদ দানা বাধে না; মন অভিশাপ দেয় না। নাড়ি ছেঁড়া ধন ওরা। তাই চুপ থাকেন...একেবারে চুপ। তবে এ নিষ্ঠুরতা তাদের কেবলই কাঁদায় ... এ কেমন নিয়তি? ভাবী আমরা কতটাই না আধুনিক স্বার্থপর! একদিন যে সন্তানের জন্য মা-বাবা ছিলেন স্নেহময়, যে সন্তান একটু আঘাত পেলেই বাবা হয়ে উঠতেন চিন্তিত। যে সন্তানকে নিজে হাত দিয়ে খাইয়ে দিয়েছেন, কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন এবং কখনই নিজের অসুবিধার কথা সন্তানদের বুঝতে দেননি। আজকাল সমাজে এমন কিছু সন্তান দেখা যায়, যারা কিনা মা-বাবার এতসব আদর-যতেœর কথা ভুলে মা-বাবাকে ঠেলে দেয় অজানা গন্তব্যে। বৃদ্ধ ও অসহায় বলে তাদের ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। ঘরের মধ্যে সবার থাকার জায়গা হলেও এখানে বৃদ্ধ মা-বাবার জায়গা হয় না। আসলে একজন মা-বাবা তার সন্তানদের জন্য যা করেন, তা তাদের পক্ষে সারা জীবনেও শোধ করা সম্ভব নয়। বুড়ো বয়সে এসে তারা চান একটু শান্তি, ভালোবাসা ও স্নেহ। এ বয়সে একটু আদর-যতœ পেলেই তারা খুশি হন। মা-বাবা চান সন্তানরা যেন তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে।

আমাদের মনে রাখা উচিত আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের বাবা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যান, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। আর যেন কখনো কোনো মা-বাবার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের জন্য তৈরি করতে হবে একটা নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close