সাহাদাৎ রানা

  ১৮ নভেম্বর, ২০১৯

মতামত

সবার জন্য নিশ্চিত হোক নিরাপদ পানি

সব প্রাণীর বেঁচে থাকতে যে খাদ্যের সবার আগে প্রয়োজন সেটি হলো পানি। অর্থাৎ প্রাণের অস্তিত্ব টিকে থাকতে পানির কোনো বিকল্প নেই। আর সুস্থভাবে একজন মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান খাদ্য হলো বিশুদ্ধ পানি। তাই বলা হয়, বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। বিশুদ্ধ পানি ছাড়া একজন মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এটা ডাক্তারদের ভাষায়ও। চিকিৎসকদের ভাষায় পানি সম্পর্কে আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। শুধু বেঁচে থাকার বিষয়ে নয়, মানুষ যতগুলো রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয় তার প্রায় ৭০ ভাগের বেশি হয় বিশুদ্ধ পানির অভাবে। অর্থাৎ পানিবাহিত কারণে। এমন তথ্যে পরিষ্কার বোঝা যায়, আমাদের জন্য বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনীয়তা কতটা ব্যাপক। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন উঠে আমরা প্রতিদিন যেসব পানি পান করছি, তা কতটা বিশুদ্ধ। সবার মধ্যে বিশুদ্ধ পানি নিয়ে আলাদা দুশ্চিন্তাও কাজ করে। কারণ আমরা ঢাকাবাসী প্রতিদিন ওয়াসা থেকে যে পানি পাই তা পান করা তো দূরের কথা, মাঝে মাঝে তা ব্যবহারেরও অযোগ্য অবস্থায় আমাদের কাছে আসে। তাই কয়েক দিন পরপর বিশুদ্ধ পানির দাবিতে আন্দোলন যেন প্রায় নিয়মিত ঘটনা। বিশেষ করে রাজধানীবাসীর জন্য তা সব সময়ই ভাবনার কারণ।

তবে সেই ভাবনা থেকে মুক্তির পথ তৈরি হয়েছে অনেকটা। আশার খবর হলো প্রায় এক মাস আগে গত ১০ অক্টোবর মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও ঢাকার সাভারে দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনের দিন থেকে দুই প্রকল্প মিলিয়ে প্রতিদিন ঢাকাবাসী পানি পাচ্ছে ৬০ কোটি লিটার। ঢাকার ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা মেটাতে ২০১৫ সালের অক্টোবরে এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুসংবাদ আরো রয়েছে- প্রধানমন্ত্রী একই দিন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আরেকটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। সেখান থেকেও ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে প্রতিদিন কয়েক কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি। উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগামী ২০২১ সালের মধ্যে সব বিভাগীয় শহরে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎসের মাধ্যমে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা হবে। এটা আমাদের জন্য সত্যিই স্বস্তির খবর।

স্বস্তির খবর এ কারণে যে, আমরা সবসময় ভয়ে থাকি বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার বিষয়ে। এক্ষেত্রে আমরা অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছি। পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা ওয়াসার নতুন এ দুটি পানির উৎস উদ্বোধনের পর ৬০ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি পেয়েছে ঢাকাবাসী। তবে লক্ষ্যমাত্রা আরো বেশি। লৌহজং উপজেলার পদ্মা যশলদিয়া পানি শোধন প্ল্যান্টের মাধ্যমে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার শোধিত পদ্মা নদীর পানি আসছে ঢাকায়। আর সাভারের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে আসছে ১৫ কোটি লিটার পানি, যা পাচ্ছে রাজধানী মিরপুরবাসী। মূলত মিরপুরের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সাভারের তেঁতুলঝরা-ভাকুর্তা এলাকায় ওয়েলফিল্ড (প্রথম পর্ব) প্রকল্প নির্মাণ করা হয়। এ প্রকল্প থেকে প্রতিদিন পানি পাওয়া যাচ্ছে ১৫ কোটি লিটার। অর্থাৎ দুই প্রকল্প মিলিয়ে প্রতিদিন ঢাকাবাসী পানি পাচ্ছে ৬০ কোটি লিটার। এতে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা অনেকটা কমে আসবে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, আমরা আমাদের ইচ্ছামতো পানি ব্যবহার করে অপচয় করব। আমাদের সবাইকে পানি ব্যবহারে আরো মিতব্যয়ী হতে হবে। অপ্রয়োজনে পানির অপচয়রোধ করতে হবে।

তবে এত আশার খবরের মাঝে কিছু অস্বস্তির খবরও রয়েছে। রাজধানীর ৫৯টি এলাকার পানি এখনো দূষিত, যা স্বীকার করে নিয়েছে ওয়াসা। তবে সাধারণ জরিপে এর সংখ্যা আরো অনেক এটা অন্তত নির্দ্বিধায় বলা যায়। অথচ ঢাকায় বসবাসরত মানুষের পানির প্রধান উৎস ওয়াসা। অভিযোগ রয়েছে কিছু কিছু জায়গায় ওয়াসার পানি পান করা তো দূরের কথা, হাতমুখ ধোয়াও দুষ্কর। দুঃখের বিষয় এই ওয়াসা থেকেই রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা মেটানো হয়। শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও তীব্র পানির সংকটও দেখা দেয়। এক্ষেত্রে সে সময় রাজধানীবাসী পড়েন বিপদে। কারণ তাদের কাছে নিরাপদ পানির সংকট মোকাবিলায় আপৎকালীন আর কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের শুধু ওয়াসার ওপর নির্ভর করে চলতে হয়। কিছু মানুষ অর্থের বিনিময়ে মিনারেল ওয়াটার কিনছেন ঠিকই, কিন্তু সেটাও কতটা নিরাপদ প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ সেখানেও বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা নেই।

বাস্তবতা হলো দেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধার আওতায় এলেও অনিরাপদ পানির কারণে এখনো অনেক মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অনগ্রসর মানুষের ক্ষেত্রে এটা বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিরাপদ পানির অভাবে সাধারণত আমাদের ডায়রিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, জন্ডিস, আমাশয়, হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস, চর্মরোগ ও মরণব্যাধি ক্যানসারের মতো ছোট-বড় সব রোগই হতে পারে। অথচ বিষয়টিকে আমরা সেভাবে আমলে নিই না। আমলে নিই শুধু আক্রান্ত হওয়ার পর। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নানা কারণে ঢাকায় বসবাসরত মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে শতকরা প্রায় ৫০ ভাগের বেশি মানুষ বিশুদ্ধ পানি পান করা থেকে বঞ্চিত। শুধু তাই নয়, নিরাপদ পানির অভাবে বিভিন্ন রোগ ও উপসর্গের প্রকোপ যেমন বাড়ছে; তেমনি এর ফলে নষ্ট হচ্ছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, যা আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের খবর।

তবে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও ঢাকার সাভারে দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের উদ্বোধনের পর আমাদের এক্ষেত্রে আশান্বিত করছে। কারণ এর মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী নিরাপদ পানি পাবে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আরেকটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। যেখান থেকে উদ্বোধনের পর পানি যুক্ত হলে চাহিদা আরো কমবে। তবে এমন আরো কয়েকটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে পানির চাহিদা আরো কমিয়ে আনার জন্য। তবেই রাজধানীবাসীর দীর্ঘদিনের নিরাপদ পানির সমস্যা প্রায় পুরোপুরি নিরসন হবে।

রাজধানীর বাইরেও নিরাপদ পানির সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামঞ্চলে। যেখানে দেখা যায়, সরাসরি মাটির অল্প গভীর থেকে যে পানি উঠানো হচ্ছে সেটায় পয়ঃনিষ্কাশনের বর্জ্য, নর্দমা ও ড্রেনের ময়লাসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক পদার্থ মিশে সেই পানি বিষ হয়ে আছে। কোনো পরীক্ষা না করেই সরাসরি সেই পানি উত্তোলন করে তা পান করছে অসচেতন মানুষ। তাই পানিবাহিত রোগব্যাধির সংখ্যাও বাড়ছে গ্রামাঞ্চলে। অল্প গভীরের পানি উত্তোলনের আরো একটি সমস্যা রয়েছে, যা অনেকটা আড়ালে থাকে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করছেন। দিন দিন এর সংখ্যাও বাড়ছে। এসব কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির সঙ্গে মিশে চলে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থে। যেখান থেকে আমরা টিউবওয়েলের মাধ্যমে পানি উঠিয়ে পান করছি। কিন্তু কোনো পরীক্ষা করা হচ্ছে না। রাজধানীর বাইরে আমরা এখনো মাটির নিচের পানিই ব্যবহার করছি। ফলে এর কুফলও পাচ্ছি আমরা। কারণ অল্প ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে গ্রামের পানির মধ্যে আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়ছে। এই আর্সেনিক কিন্তু আমাদের একদিনের সমস্যা নয়। হাজার বছর ধরে আমাদের মাটিতে আর্সেনিক ছিল, এখনো আছে। কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই এসব পানি পান করায় মানবদেহে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ-জীবাণু বাসা বাঁধছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আর সেসব পানি পরিশোধন করতেও জানে না সাধারণ মানুষ। অনেক সময় পানি পরিশোধন করতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে রোগব্যাধি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই দিন দিন গ্রামে নিরাপদ পানি পাওয়াটা অনেকটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে সব বিভাগীয় শহরে ভূ-উপরিস্থ উৎসের মাধ্যমে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে পারলে অনেকাংশে সমস্যার সমাধান হবে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন সব বিভাগীয় শহরে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎসের মাধ্যমে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা হবে। তবে এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগও বাড়াতে হবে।

তবে এখন মানুষের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা এসেছে যে, ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের চেয়ে প্রাকৃতিক পানি ব্যবহার বেশি নিরাপদ। বিশেষ করে বৃষ্টির পানি ধারণ করে এখন অনেকে ব্যবহার করছেন। তবে এর ব্যবহারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বৃষ্টির পানি ব্যবহারের সংখ্যা বাড়লে তবেই নিশ্চিত হবে নিরাপদ পানি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি বেশি বেশি ব্যবহারে আমাদের সচেতন হতে হবে। কারণ এ বিষয়ে সবাই তেমন সচেতন নয়। আবার অনেকে জানে না বৃষ্টির পানি কতটা নিরাপদ। তাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সবার মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি। মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়লে নিরাপদ পানির পরিমিত ব্যবহার যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি পানির অপচয়ও রোধ করা সম্ভব হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close