ইসমাইল মাহমুদ

  ১২ নভেম্বর, ২০১৯

মিলনতীর্থ

মণিপুরি সম্প্রদায়ের ‘মহারাসলীলা’

ঐতিহ্যবাহী রাসলীলানুকরণ মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের শিববাজারস্থ জোড়ামন্ডপ এবং আদমপুরস্থ তেতুইগাঁও সেনাঠাকুরের প্রধান মন্ডপে প্রতি বছর ঐতিহ্যবাহী মহারাসলীলায় নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। আগামী ১২ নভেম্বর দামোদর মাসখ্যাত কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণিপুরিদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব রাসপূর্ণিমা বা মহারাসলীলা অত্যন্ত সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হবে। ১২ নভেম্বর বেলা ১১টা থেকে ১৩ নভেম্বর ঊষালগ্ন পর্যন্ত চলবে উৎসব। প্রতি বছর কঠোর নিরাপত্তা ও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশ ও বহির্বিশে^র লক্ষাধিক দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। মণিপুরি সম্প্রদায়ের পুণ্যস্থান হিসেবে বিবেচিত মাধবপুর ও আদমপুরে রাসোৎসবের জন্য তৈরি সাদা কাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলো ওই একটি রাত্রির জন্য হয়ে উঠে লাখো মানুষের মিলনতীর্থ। মণিপুরি শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুণ নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের।

১২ নভেম্বর বেলা ১১টায় উভয় স্থানে একযোগে রাখাল নৃত্য বা গোষ্ঠলীলা অনুষ্ঠিত হবে; যা গোধূলিলগ্ন পর্যন্ত চলবে। রাত ১২টা থেকে শুরু হবে মাধবপুর জোড়ামন্ডপের তিনটি মন্ডপে তিনটি রাস এবং আদমপুর সেনামন্ডপে একটি রাস। পরদিন ১৩ নভেম্বর ঊষালগ্ন পর্যন্ত মণিপুরি রাসনৃত্য চলবে।

গোষ্ঠলীলায় অংশগ্রহণকারী বালকরা রাখাল সেজে, মাথায় কারুকার্যখচিত ময়ূরপুচ্ছ সুশোভিত এবং হাতে বাঁশি নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যজীবনের বহু ঘটনা এ নৃত্যানুষ্ঠানে ফুটিয়ে তুলবেন। রাসলীলায় শ্রীকৃষ্ণের মতোই থাকবে তাদের পোশাক। আকর্ষণীয় মন্ডপ যুবতী গোপনীদের নৃত্যে প্রাণময় হয়ে উঠবে। অসংখ্য ভক্ত-পুণ্যার্থী গোষ্ঠী ও রাসলীলা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে বাতাস (এক প্রকার মিষ্টান্ন), টাকা-পয়সা ছিটিয়ে দেবেন নৃত্যরত শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধা গোপিনীদের ওপর। রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রতি বছর মন্ডপগুলোর আশপাশে বসে বিরাট মেলা। মেলাকে প্রাণবন্ত করে তোলে তালপাতার বাঁশি, চুড়ি, শিশুদের খেলনা ও নানা রকম বেতের তৈরি আসবাবপত্র।

একসময় কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরেই হতো রাসোৎসব। কিন্তু ১৯৮৬ সালে মণিপুরিদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে একপর্যায়ে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ এবং ‘মৈথৈ’ মণিপুরিরা সম্পূর্ণভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে ১৯৮৬ সালে থেকে ‘মৈতেই’ মণিপুরিরা আদমপুরে অবস্থিত তেতইগাঁও মণিপুরি কেন্দ্রীয় সেনামন্ডপে রাসলীলা উৎসব পালন করে আসছে। তবে এ রাসলীলা উৎসব বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি অধ্যুষিত মাধবপুর জোড়া মন্ডপের রাসলীলা উৎসবের মতো এত বিশাল আকারে অনুষ্ঠিত হয় না।

রাস উৎসব কী? : মণিপুরি ললিতকলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত একাধিক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রস থেকে ‘রাস’ শব্দের উৎপত্তি। ‘রাস’ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সর্বোত্তম মধুর রস। অতএব রাসলীলা বলতে শ্রীকৃষ্ণ তারই হলাদিনি শক্তি শ্রীরাধা ও অন্য গোপীগণের সঙ্গে যে লীলাখেলা করেছেন তাকেই বোঝায়। মণিপুরি সমাজে প্রচলিত রাসনৃত্যকে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাÑ ১. শারদীয় মহারাস, ২. বসন্ত রাস, ৩. নিত্য রাস, ৪. কুঞ্জ রাস, ৫. গোপ রাস ও ৬. উদুখল রাস। এর মধ্যে শারদীয় মহারাস হচ্ছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা সংগঠিত লীলাসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলেই একে মহারাসলীলা বলা হয়ে থাকে। প্রতি বছর শারদীয় পূর্ণিমা তিথিতে মাধবপুরের জোড়ামন্ডপে এ রাসলীলানুসরণের আয়োজন করা হয়। মাধবপুরের রাসলীলা অনুষ্ঠান এবার হবে ১৭৭তম আয়োজন। রাধাকৃষ্ণ কেন্দ্রীভূত এই মহারাসলীলা মণিপুরি সম্প্রদায়ের অত্যন্ত সাড়ম্বরপূর্ণ একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মণিপুরি সম্প্রদায়ের মূল আবাসস্থান ভারতের মণিপুর রাজ্যের বাইরে বাংলাদেশের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপেই সর্বপ্রথম মণিপুরি রাসলীলার প্রচলন ঘটে। ১২৪৯ বঙ্গাব্দে (১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ রেকর্ডমতে) রাসলীলানুষ্ঠানের আয়োজন করলেও মূলত তার বহু পূর্ব থেকেই এর প্রচলন ঘটে বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।

হাজার হাজার বছর পূর্বে শ্রী বৃন্দাবনে রাসলীলার আবির্ভাব হলেও মণিপুর রাজ্যে ২৩০ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে এর প্রচলন হয়েছে। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র ওরফে জয়সিংহ-এর শাসনামলে মণিপুরে এই লীলার শুরু হয়। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র বৈষ্ণবধর্মের আচরণীয় শ্রীমদ্ভাগবতের রাস পঞ্চাধ্যায় পঠন সেবায় ব্রত হন। কিন্তু ভগবৎকৃত রাসলীলা-গোপী, সখি ও মঞ্জুরিসহ বিরাজমান দৃশ্য চাক্ষুস দর্শনে অপারগ হয়ে নিজে শ্রী গোবিন্দ জিউর চরণে প্রাণপাত শয়নে গেলেন। তন্দ্রাবস্থায় তিনি দেখতে পান যে, শ্রীবৃষ্ণ-শ্রীরাধা, গোপীসহ দিব্য রাসলীলা করছেন। সে আলোকেই তিনি রাসের চার প্রকার তাল তৈরি করেন। এগুলো হচ্ছেÑ ১. চালি পারেং, ২. ভঙ্গি পারেং, ৩. খোবাক পারেং এবং ৪. বৃন্দাবনী পারেং। অতঃপর মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র কয়েকজন কুমারী মেয়ে দ্বারা স্বপ্নের মতো বাস্তবে রাসলীলা করালেন। এতে নিজ কন্যা কুমারী বিশ্বাবতীকে শ্রীরাধা এবং মন্দিরের শ্রীগোবিন্দকে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাসলীলা করেন এবং তিনি নিজেই উক্ত রাসে মৃদঙ্গ বাদক ছিলেন। তাতে তিনি তার তৈরি তাল ব্যবহার করেন। উল্লেখ্য যে, তা আজ অবধি মণিপুরি রাসলীলায় অঙ্গীভূত হয়ে আছে।

মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র ওরফে জয়সিংহ কেবল রাসলীলা ও তাল প্রবর্তন করেই ক্ষান্ত হননি। রাসলীলার বিভিন্ন আঙ্গিক, পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়েও গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। রাজা ভাগ্যচন্দ্র প্রথম রাস শুরু করেছিলেন। তাই মণিপুরি রাসলীলা শ্রুরু করার সময় ‘রাস আরম্ভিল ভাগ্যচন্দ্র মনোহর’ বলে রাস শুরু করা হয়। তার রচিত গোবিন্দ সংগীত ‘রাসলীলা’ ছাড়াও জয়দেব, বিদ্যাপতি, চন্ডিদাস প্রমুখ বৈষ্ণব কবির পদাবলিকে আশ্রয় করে মণিপুরি সমাজে রাসনৃত্যের রূপায়ণ লক্ষ করার বিষয়। এসবের অনুকরণে মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র তার গ্রন্থ রচনা করেন।

ভাগ্যচন্দ্র নিজে ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। নৃত্যের বিভিন্ন ভঙ্গি এবং মুদ্রার তালে যখন এ গান রাসলীলায় গীত হয়; তখন কৃষ্ণভক্তরা মোহবিষ্ট না হয়ে পারেন না। প্রত্যেক রাসেই শ্রীকৃষ্ণের জীবের বৈচিত্র্যের বিভিন্ন দিকের বিষয়বস্তু অভিনীত হয়। উল্লেখ যে, শ্রীকৃষ্ণের বংশিধ্বনি শুনে ব্রজগোপীরা যেখানে যে অবস্থায় ছিল, সবাই সে অবস্থায় চলে আসত। শুধু তাই নয়, বন্ত্রাভরণের বিপর্যয় অবস্থায় পর্যন্ত তাদের চোখে দৃষ্টিপাত হতো না। শ্রীকৃষ্ণ ব্রজগোপীকে নিয়ে বিমুগ্ধ বিহার করতেন এবয় ব্রজগোপীরাও প্রেমে আপ্লুত হয়ে নিমজ্জিত হতেন। শ্রীকৃষ্ণ তাদের থেকে যখন সেই মুহূর্তে অন্তর্নিহিত হতেন গোপীরা তখন হা-কৃষ্ণ, হা-কৃষ্ণ বলে রোদন করতে করতে বনে প্রবেশ করে তাকে খুঁজত। বনের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্নসহ কোনো গোপ বধূর পদচিহ্ন আবিষ্কার করে তারা বুঝতে পারত শ্রীকৃষ্ণ তাদের ত্যাগ করে অন্য ষ্কূর সঙ্গে বিহারে গেছেন। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে ওই ব্রজবধূরা একাকী কাঁদত। তারা ভাবত, শ্রীকৃষ্ণ উধাও হয়ে গেছেন। এ কথা শুনে সমবেতভাবে শ্রীকৃষ্ণের স্তুতিগান করতে উদ্যত হতো, তা ১১টি শ্লোকে সমাপ্ত। এভাবে বিরহকাতর প্রেমমুগ্ধ গোপিনীরা সমবেতভাবে যে বন্দনা রচনা করেন তাই শ্রীকৃষ্ণের ‘রাসমন্ডপ’ হিসেবে অনুমিত হয়। শ্রীকৃষ্ণ রাসমন্ডপে প্রবেশ করলে গোপিনীরা প্রত্যেকেই ভাবতে থাকত শ্রীকৃষ্ণ তারই একান্ত কাছে আছেন। আর এর ফলেই ‘রাসমন্ডপ’ রচনা করে নৃত্যগীত উৎসব হতো। ‘রাসমন্ডপ’-এ নৃত্য রচনার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ যে প্রত্যেকের কাছে আছেন, তার মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্ন মূর্তিতে অদ্ভুত শক্তির বহুল প্রকাশ ঘটাতেন। শ্রীকৃষ্ণের বিচিত্র মহিমা ও শক্তির প্রকাশ মণিপুরি রাসলীলায় পরিস্ফুটিত হয়ে বিশেষত্ব সহকারে উৎসবের আকারে রূপ নিয়েছে।

মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা ও গোপীগণকে যে অপ্রাকৃত পোশাক-পরিচ্ছেদ ভূষণে দর্শন করেছিলেন তা তিনি অনুরূপভাবে নিজ কন্যার রাসলীলায় ব্যবহার করেছিলেন। এখন পর্যন্ত রাসলীলানুষ্ঠানে এ ধরনের অপ্রাকৃত পোশাক-পরিচ্ছেদ ব্যবহার করা হয়। মণিপুরি নৃত্য মূলত রাসলীলারই প্রতিফলন। রাসলীলা বিভিন্ন আঙ্গিক ও মুদ্রা সমন্বয়ে মণিপুরি নৃত্যের ব্যাপকতা ও সাবলীলতা। এ নৃত্যে পোশাকের মধ্যে তেমন কোনো বাহুল্য নেই। গোপীরা ও শ্রীরাধার পোশাক মাথায় চূড়ার ওপর ‘ককনাম’, মুখে পাতলা সাদা কাপড়ের ঢাকনা বা ‘মেইকুম’, গায়ে রেশমি ব্লাউজের ওপর জড়ানো সাদা লংক্লথ ‘থাব্রেৎ’সহ ছোটখাটো বিভিন্ন সামগ্রীর ব্যবহার বিশেষ করে চন্দন, পাউটার ইত্যাদি এবং কৃষ্ণের নৃত্যে মাথায় কারুকার্যখচিত ময়ূরপুচ্ছসহ ‘লেইত্রেং’ ও ‘জরি’, গায়ে কুটি বস্ত্রসহ ‘খৌওল’ ও পরিধানে গেরুয়া ধূতিসহ পায়ে নূপুর ব্যবহার নৃত্যকে কামনীয়, আকৃষ্ট ও মোহবিষ্ট করে তোলে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাঝে মাঝে স্বর্ণালংকারও ব্যবহার হয়। তাই তাল, নৃত্য, পোশাক-পরিচ্ছেদ ইত্যাদির দিক থেকে মণিপুরি রাসলীলা অন্যান্য রাসলীলা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। লীলানুসরণ শ্রীরাধা ও গোপীগণের বিরহের সমবেদরায় রাস উৎসবে উপস্থিত অনেক দর্শক-শ্রোতা কেঁদে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

প্রতি বছর মণিপুরি সম্প্রদায়ের বাড়িতে বাড়িতে কুমারী কিশোরদের রাসলীলায় অংশগ্রহণ করার জন্য নৃত্য ও সংগীতের তালিম দেওয়া যায়। আনুমানিক ৪০-৫০ জন কিংবা ততোধিক সংখ্যার কিশোরী এ রাসলীলায় অংশগ্রহণ করে থাকে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট [email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close