এস এম মুকুল

  ০৪ নভেম্বর, ২০১৯

দর্শন

সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করাই জীবন

আমার মতে, সৃজনশীলতা ‘ম্যানেজেরিয়াল’ নয়, বরং ‘ইম্যাজিনেরিয়াল’ কনসেপ্ট। কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার অর্থ প্রেরণা জোগানো। স্ট্যাটিসটিকস আর সংখ্যা দিয়ে শুধু ব্যাংকার আর স্টক ব্রোকারদেরই অনুপ্রাণিত করা যায়। কারণ প্রেরণার সঙ্গে আবেগের যোগ রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা পণ্যের প্রতি মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে চিন্তাশক্তির জোর থাকতে হবে। ভাবনা আবদ্ধ থাকলে সৃজনশীলতা বাধা পায়। জীবনের চড়াই-উতরাই আপনি তখনই উপভোগ করবেন, যখন দুই চোখ খোলা রেখে সব চ্যালেঞ্জকে আহ্বান জানাবেন। সৃজনশীলতায় ভর করে প্রকৃত সাফল্য পেতে গেলে ‘পজিটিভ ভাইবস’ খুব জরুরি। আর তা তখনই সম্ভব, যখন অন্যদের জন্য ভালো কিছু করার জিকির থাকবে আপনার মধ্যে। সেটাই যেকোনো সৃজনশীল নেতার মূল ভিত্তি। এ কথাগুলো নন্দিত অভিনেতা নায়ক শাহরুখ খানের। বলিউডে অন্যতম এ অভিনেতা ভারতের বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (আইআইএমবি) আয়োজিত আইআইএমবি লিডারশিপ সামিটে এই বক্তব্য দেন; যা টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত হয়।

তার মতে, জীবনের সারসত্য হলো কঠোর পরিশ্রম। পরিশ্রম ছাড়াই স্বপ্নের উড়ান গতি পাবে, এটা ভাবার অর্থ মূর্খের স্বর্গে বাস করা। তিনি বলেন, আমি কোনো দিন নিজের লক্ষ্য স্থির করি না। বক্স অফিসে কয়েকশ কোটি টাকা আয়ের উদ্দেশ্যেও ঝাঁপাই না। কারণ এ ধরনের লক্ষ্য স্থির করার অর্থ নিজেকে বিভ্রান্ত করা। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের গুরুত্ব রয়েছে। নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য না ঝাঁপালে জীবন সাদামাটাই থেকে যাবে। তবে এর জন্য বিপর্যয়ের ঝাপটাও পোহাতে হয় লিডারদের। তিনি আরো বলেছেন, ব্যর্থতায় পিছিয়ে এলে চলবে না। বরং ক্রিজে টিকে থেকে মোকাবিলা করতে হবে। আমি বিশ্বের অনেক সফল করপোরেটের সংস্পর্শে এসেছি। আমি বিশ্বের অনেক সফল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছি, কাছ থেকে দেখেছি, তাদের কখনো জটিল মনে হয়নি। তাদের আইডিয়া পরিষ্কার এবং তারা সোজাসাপ্টা কথা বলেন।

আইনস্টাইন বলতেন, ‘আমার কোনো বিশেষ প্রতিভা নেই। আমি শুধু মনেপ্রাণে কৌতূহলী।’ তার কথাটিও দারুণ। মিউনিখ শহরের নেতৃস্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মিউনিখ জিমনেসিয়ামের এক শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কখনোই কোনো কিছুকে পূর্ণতা দিতে পারবে না, আইনস্টাইন।’ যে মানুষটি শৈশবে দেরিতে কথা বলতে শিখেছিলেন, যার একাডেমিক ফলাফল দেখে কোনো শিক্ষক আশান্বিত হতে পারেননি, যিনি প্রথাগত শিক্ষায় বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, সেই মানুষটি এক বছরে চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। আইনস্টাইনের বয়স যখন ১৫ বছর; তখন এক শিক্ষক তাকে স্কুল ছাড়ার জন্য জোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই শিক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, ‘তোমার উপস্থিতি আমার প্রতি ক্লাসের সম্মানকে নষ্ট করে দেয়।’ আইনস্টাইন এই পরামর্শকে সাগ্রহে গ্রহণ করে ইতালির উত্তরাঞ্চলে কয়েক মাস উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। আইনস্টাইন সব সময় মহাবিশ্বের রহস্যময় সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন, তিনি এই আপাত অভেদ্য রহস্যকে ভেদ করার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়েকজন মানুষ তাদের কাজের মাধ্যমে আমাদের চারপাশের জগৎকে পুনর্র্নির্মাণ করেছেন তাদের মধ্যে আইনস্টাইনের নাম প্রণিধানযোগ্য। তিনি যেমন একজন বৈজ্ঞানিক রোল মডেল হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন; তেমনি সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতির বিষয়ে ছিলেন সচেতন। আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় আছেন। বিশিষ্ট বিজ্ঞান জনপ্রিয়কারক কার্ল সেগানের মতে, আইনস্টাইন না থাকলে ১৯২০-এর দশকের পরবর্তী সময়ের নবীন বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক কর্মোদ্যোগের কথা জানতেই পারতেন না।

আইনস্টাইন যে সর্বকালের অন্যতম সেরা পদার্থবিজ্ঞানী হতে পারেনÑ এমন সম্ভাবনার কথা কয়েকজন ইউরোপীয় পদার্থবিজ্ঞানী ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন। এরপরও আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে তার কাজ বিতর্কিত ছিল। একজন নেতৃস্থানীয় জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী এক চিঠিতে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পদে আইনস্টাইনের জন্য সুপারিশ করতে গিয়ে তাকে সত্যিকারের একজন উৎকৃষ্ট চিন্তাবিদ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, যদিও তিনি আপেক্ষিকতাবাদকে একটি প্রকল্পিত প্রমোদ ও ক্ষণিকের বিকার হিসেবে ইঙ্গিত করেছিলেন। তিনি কথা বলতে শিখেছিলেন দেরিতে, যা নিয়ে তার পিতা-মাতা খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন এবং ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। স্কুলে তিনি ছিলেন মাঝারি মানের ছাত্র। সেসময়ে ইউরোপজুড়ে বিরাজমান কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনমনীয়তাকে আইনস্টাইন ভালো চোখে দেখতেন না। শিক্ষায়, বিজ্ঞানে ও রাজনীতিতে কঠোর নিয়মানুবর্তী লোকদের খুবই অপছন্দ করতেন। মুখস্থ বিদ্যার প্রতি তার ছিল তীব্র অনীহা। স্কুলের শিক্ষকদের কথা মনে হলে তার মানসপটে ড্রিল সার্জেন্টের ছবি ভেসে উঠত। ছোটখাটো চাকরি করে নিজের খরচ চালানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। এ ছাড়া আকাক্সিক্ষত পদগুলোতে উপেক্ষিত হওয়ার পর মার্সেল গ্রসম্যানের বাবার হস্তক্ষেপে আইনস্টাইন বার্নে অবস্থিত সুইস পেটেন্ট অফিসে আবেদনপত্রের পরীক্ষক হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। প্রায় একই সময়ে তিনি তার জার্মান জাতীয়তা ত্যাগ করে সুইস নাগরিক হন। তিন বছর পর ১৯০৩ সালে তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রেমিকাকে বিয়ে করেন। প্রথম দিকে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বকে প্রশ্নাতীতভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আইনস্টাইন তার কাজের প্রমাণ হিসেবে ইতিপূর্বে প্রকাশিত আপেক্ষিকতাবাদের গবেষণাপত্রটি সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়ে আরো একবার শিক্ষাজীবনে প্রবেশ করার চেষ্টা চালান। তিনি একে স্পষ্টভাবে একটি সার্থক গবেষণা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু তার কাজকে দুর্বোধ্য বলে অগ্রাহ্য করা হয় এবং আইনস্টাইন ১৯০৯ সাল পর্যন্ত পেটেন্ট অফিসে কর্মরত থাকেন। অবশ্য তার প্রকাশিত কাজগুলো আর অগোচরে থাকেনি। অপার বিস্ময় ও সীমাহীন কৌতূহলকে সঙ্গী করে তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসে দ্বিতীয় ধহহঁং সরৎধনরষরং-এর প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিকে আরো বিস্তৃত করেছেন। তাই তার বিজ্ঞান সাধনা ও সাফল্যের আখ্যান আমাদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।

ডিজনি বেশ কয়েকটি মারাত্মক জনপ্রিয় মোবাইল গেমসের নির্মাতা। ডিজনি ইন্টার?-অ্যাকটিভের মোবাইল সার্ভিস প্রডাক্টসের সাবেক পরিচালক রাজিব বেহেরা। ১০০ জন কর্মীর স্টুডিওতে অসংখ্য গেম বানানো হয়েছিল তারই নেতৃত্বে। কর্মজীবনে এমন বিশাল একটি প্রতিষ্ঠানে সফলতা ও ব্যর্থতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বেহেরা। দিনে ১০ ঘণ্টা কঠিন পরিশ্রম করে তিনি সফল হন। তবে তার সফলতার পেছনে কয়েকটি জিনিস কাজ করেছে যেগুলোকে তিনি মূলমন্ত্র বলে বর্ণনা করেছেন। তার সফলতার মূলমন্ত্রগুলো অন্যদের জন্যও পথপ্রদর্শক হতে পারে। তিনি তার জীবন থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতায় বলেছেন, ব্যর্থতার দায় নিজের কাঁধে নিতে হবে। এ মানসিকতা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে। ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার মাধ্যমে ভুল চিহ্নিত করে নিজেকে আরো দক্ষ করে তুলুন। বিশ্বাসযোগ্যতা ব্যর্থতায় ঘুরে দাঁড়ানোর অন্যতম শক্তি। ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার মাধ্যমে ভুল চিহ্নিত করে নিজেকে আরো দক্ষ করে তুলুন। শুরুতেই আসন্ন সম্ভাব্য সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এতে আশপাশের মানুষ আপার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাবেন। পরিকল্পনা নিñিদ্র থাকলে প্রাণোচ্ছলতা নিয়ে কাজ করতে পারবেন। যেকোনো কাজে আগে ঝুঁকি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবেÑ এ কাজে পা বাড়াবেন কি না। এতে নেতৃত্বের ওপর বিশ্বাসযোগ্যতা আসে। ভুল হবেই। আর তা থেকে শিক্ষা নিতে ভুল করবেন না। এ শিক্ষা ভবিষ্যতে আপনাকে ভুল থেকে দূরে রাখবে। কোনো কাজে সফল নাও হতে পারেন। আর তা না হতে পারলে আবারও নতুন পরিকল্পনায় ফিরে আসতে হবে।

বিশ্বের সব থেকে নামকরা ব্যাগ লেস ভ্যাকুয়াম ক্লিনার্সের মালিক জেমস ডাইসন একজন সফল ব্যক্তি। বিশ্বে ৫০টিরও বেশি দেশে চলছে। মজার ব্যাপার হলো, এ মেশিনটিকে যথাযথ রূপ দেওয়ার আগে জেমস ডাইসনকে ব্যর্থ হতে হয়েছিল পাঁচ হাজারবারেরও বেশি। এজন্য জেমস ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করেন পাঁচটি বছর। এই ভ্যাকুয়াম তৈরির জন্য তিনি নানা ধরনের আইডিয়া তৈরি করতেন, কিন্তু সবগুলো ব্যর্থ হতেই থাকে। এভাবে তিনি দিন দিন পরিবারকে কষ্ট দিচ্ছিলেন। কিন্তু কোনো উপায় বের হচ্ছিল না। তিনি হতাশ হতেন না, কিন্তু বাস্তবতা তাকে পেছনে ফেলে দিচ্ছিল ভ্যাকুয়াম ক্লিনার্সকে পুরোপুরি দাঁড় করানোর জন্য চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। এ সময় তাকে স্ত্রীর উপার্জন দিয়েই চলতে হয়েছে। এমন অনেক পরিস্থিতি এসেছে, যাতে হাল ছেড়ে দেওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু জেমসের কাছে এটা শুধু একটা মেশিন আবিষ্কার ছিল না, এটা ছিল তার জীবন।

মেশিনটি তৈরি হলেও এটিকে কেনার জন্য কোনো কোম্পানিকে রাজি করাতে পারেননি। তিন বছর তিনি শুধু এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানির দরজায় ঘুরেছেন। সবাই মেশিনের কার্যক্ষমতার প্রশংসা করলেও বাজারে চলবে কি না, এটা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। কারণ বাজার সয়লাব হয়ে আছে ব্যাগওয়ালা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারে। সেখানে এ রকম ব্যাগহীন একটা ভ্যাকুয়ামকে ক্রেতারা কীভাবে নেবে, সেটা নিয়েই সবার ভয়। অবশেষে ১৯৯৩ সালে জেমস নিজেই এটির বাজারজাতের উদ্যোগ শুরু করলেন। মাত্র দেড় বছরের মাথায় ডিসি ০১ হয়ে উঠল বাজারের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। অনেক চেষ্টার পর এখন তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনীর একজন। ৭৮০ কোটি পাউন্ড নিয়ে ধনীদের তালিকায় নিজের স্থান দখল করেছেন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close