ইসমাইল মাহমুদ

  ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

বিলুপ্তির পথে ক্ষুদ্র নৃ-মাতৃভাষা

বাংলাদেশ সরকারের সম্প্রতি প্রণিত গেজেড অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ৫০ জাতের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। তারা হলো ওরাঁও, কোচ, কোল, খাসিয়া বা খাসি, খিয়ং, খুমি, মারমা, পাংখোয়া বা পাংখো, গারো, পাহাড়ি বা মালপাহাড়ী, চাক, চাকমা, ডালু, তঞ্চঙা, ত্রিপুরা, বম, বর্মণ, মণিপুরী, মুন্ডা, ম্রো, রাখাইন, লুসাই, বড়াইক বা বাড়াইক, সাঁওতাল, হাজং, মাহাতো বা কুর্মি মাহাতো বা বেদিয়া মাহাতো, কন্দ, কড়া, গঞ্জু, মালো বা ঘাসিমালো, গড়াইত, গুর্খা, তেলী, তুরি, পাত্র, বাগদী, বানাই, বেদিয়া, ডিল, ভূমিজ ভূইমালী, খারিয়া বা খাড়িয়া, মাহালী, মুসহর, রাজোয়াড়, লোহার, শবর, হুদি, হো এবং খারওয়ার বা খেড়োয়ার। এসব নৃ-গোষ্ঠী বা আদিবাসীদের লোকজনের অধিকাংশই পাহাড়ে ও যৎসামান্য কিছু সমতলে বসবাস করছেন। প্রকৃতির সাথে তাদের নিগুঢ় সম্পর্ক বিদ্যমান।

বনাঞ্চল, চা বাগান আর পাহাড়ি টিলাবেষ্টিত বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, প্রথা, ধর্মীয় ভাবধারা ও উৎসব বাঙালিদের মুগ্ধ করে। তাদের প্রত্যেকেরই একসময় নিজস্ব মাতৃভাষা ছিল। কিছু কিছু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা আজ হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে। আর বাকিদের মাতৃভাষা নানা সমস্যার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা বিপন্নের অন্যতম কারণ হলো তারা নিজেদের মাঝে তাদের ভাষাচর্চা করেন না। এর বিপরীতে তারা বাংলা ভাষায় অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এ ছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা কেন্দ্র নেই এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা, নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি বর্তমানে চরম হুমকির মুখে।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। তথাপি তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমির অধিকারসহ নানা জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন। পাশাপাশি তারা তাদের নিজস্ব মাতৃভাষাকেও হারাতে বসেছে। নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক মাতৃভাষা চর্চাকেন্দ্র না থাকা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, নিজেদের বাড়িঘরসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার অধিক পরিমাণে করার ফলে ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার হারিয়ে যাচ্ছে বলে গবেষকরা জানান।

দেশের চা-শিল্পাঞ্চলে অসংখ্য ভাষাভাষীর মানুষ রয়েছেন। তবে তাদের অধিকাংশই বাংলা ভাষায়-ই কথা বলেন। নিজস্ব মাতৃভাষা কেউ ব্যবহার না করার কারণে এবং বাড়িঘরেও চর্চা না থাকায় চা-শিল্পাঞ্চলের নানা ভাষাভাষীর নিজেদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মাতৃভাষা চর্চা কেন্দ্র চালু করা অতি আবশ্যক বলে গবেষকদের অভিমত।

দেশের সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় অসংখ্য খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করেন। পাহাড়ে তারা পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তাদের গুচ্ছবদ্ধ গ্রাম পানপুঞ্জি বা খাসিয়া পুঞ্জি নামে পরিচিত। এসব পানপুঞ্জি বা খাসিয়া পুঞ্জিতে খাসিয়ারা তাদের নিজস্ব ভাষা চর্চা রাখার জন্য নিজেদের অর্থায়নে স্কুল পরিচালনা করে থাকেন। এসব স্কুলে খাসিয়া ভাষা ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া খাসিয়ারা তাদের প্রতিটি ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা একাডেমিক ব্যবস্থা না থাকার কারণে নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি এখন হুমকির মুখে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে খাসিয়াদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে।

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ৭০টি খাসিয়া পুঞ্জি রয়েছে। এ ৭০টি পুঞ্জির মধ্যে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার আলীয়াছড়া পানপুঞ্জি এবং সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের নকশিয়ার পানপুঞ্জিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বাকি ৬৮টি পানপুঞ্জিতে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এসব পুঞ্জিতে খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন নিজেদের মধ্যে চাঁদার ব্যবস্থা করে কমিউনিটি বিদ্যালয় পরিচালনা করেন। এসব কমিউনিটি বিদ্যালয়ে নিজস্ব ভাষা চর্চার চেষ্টা চলছে। ভাষা রক্ষার স্বার্থে সরকারকে বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে এবং এ চর্চাকে বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া আজ সময়ের দাবি বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close