মজিবর রহমান

  ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পর্যালোচনা

রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা

আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন এ মুহূর্তে দেশের গুরুতর সমস্যা কোনটি; আমি নিঃসংশয়ে তার উত্তরে বলব রোহিঙ্গা সমস্যার কথা। ১৯৭৮ সালে একবার এরা সমস্যা করেছিল, ২ লাখ চলে এসেছিল আমাদের এখানে। পরে ফিরে গিয়েছিল বটে, তবে কিছু নিশ্চয়ই থেকে গিয়েছিল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে। এরপর ১৯৯২ সালে আবার আসে তিন লাখ। এদের গরিষ্ঠ অংশ ফিরে গেলেও থেকে যায় একাংশ। কিন্তু এবার যেটি হলো তা অকল্পনীয়। ২০১৭ সালে আগস্ট ২৫-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখ রোহিঙ্গা। নতুন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার কারণে এ সংখ্যা নিশ্চয়ই বাড়ছে দ্রুত, যা আপাতত হিসাবে আসছে না।

কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়ায় ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে আছে এই বিপুলসংখ্যক মানুষ। এরা নিবন্ধিত, নিবন্ধনের বাইরেও নিশ্চয়ই আছে আরো অনেকে। রোহিঙ্গার সংখ্যা যদি ১১ লাখও ধরি তাতেও তারা আমাদের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চেয়ে অনেক বেশি। স্থানীয়রা সংখ্যায় ৫ লাখ। অর্থাৎ আমরা সেখানে সংখ্যালঘিষ্ঠ। সংখ্যাগরিষ্ঠের উৎপাতের নানা খবর ইতোমধ্যে আসা শুরু হয়েছে। মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে তারা। অনুমান করা যায়, পরিস্থিতি অদূর ভবিষ্যতে আরো খারাপ হবে প্রতিকার না হলে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে আশ্রয়শিবিরে সর্বক্ষণ নজরদারির মধ্যে রাখা সম্ভব নয়। এরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়বেই এবং নানা অপকর্মে জড়াবে।

দুই.

রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের বেলায় কোনো দেশই এখন আর আবেগকে প্রশ্রয় দেয় না। ১১ লাখ তো দূরের কথা ১১ জনকেও অন্য কোনো দেশ সহজে ঢুকতে দিত কি না, সন্দেহ আছে। আমরা দিয়েছি অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই। তখন কেবল সরকার নরম ছিল তা নয়, জনসাধারণও নরম ছিল। আমাদের গণমাধ্যম তখন প্রতিযোগিতা করে আশ্রয় দেওয়ার মাহাত্ম্য কীর্তন করেছে। এখন প্রকৃত পরিস্থিতি আঁচ করে উল্টো দিকে টলছে। বললে বেশি হবে না, রাজনৈতিক দলগুলো সেসময় এই রোহিঙ্গাদের কাছে টানার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। পরিণাম নিয়ে কোনো দলই ভাবেনি। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ একাত্তরের কথা তোলেন। পাক বাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য সেসময় ১ কোটি লোক শরণার্থীরূপে ভারতে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছিল। সে পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান রোহিঙ্গা পরিস্থিতির কোনো সামঞ্জস্য নেই। আশ্রিতরা সেদিন স্বজনদের যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, নিজেরাও সহায়তা করেছেন যে যার মতো। যুদ্ধে জিতবে সে ভরসা ছিল তাদের শতভাগ। ভারত নিশ্চিত ছিল যে, এ আশ্রয় সাময়িক, যুদ্ধে জিতে এরা ঘরে ফিরবে দ্রুত। এতে বরং ভারতের সুবিধাই হবে, পাকিস্তান নামক আপৎটি ডানা ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়বে। তা ছাড়া সেদিন কেবল ভারতই বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না, পক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ও অন্যান্য কল্যাণকামী দেশও। বিপরীতপক্ষে দেখা যাচ্ছে এক বাংলাদেশ ছাড়া রোহিঙ্গাদের পক্ষে কেউ নেই।

তিন.

কক্সবাজার বাংলাদেশের সুপরিচিত ও প্রাচীন পর্যটন কেন্দ্র। পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকতের অবস্থান সেখানে। পাহাড়-সমুদ্রঘেরা এ জেলার টেকনাফ ও উখিয়াতে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। সেখান এবং নিকটবর্তী উখিয়াতেই আছে কি না ৩৪টি আশ্রয় কেন্দ্র, যেখানে বাস করে ১১ লক্ষাধিক অতিরিক্ত মানুষ! বুঝতে অসুবিধা হয় না, স্থানটি কেমন বিধ্বস্ত এখন। পাহাড় শেষ হয়ে যাচ্ছে, শেষ হচ্ছে বন। বনের পশু নিঃশেষ হচ্ছে, এমনকি বন্ধ হচ্ছে হাতি চলাচলের রাস্তাও। এভাবেই প্রাকৃতিক পরিবেশ তো নষ্ট হচ্ছেই, বিনষ্ট হচ্ছে মানবিক পরিবেশও। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে আগত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরে বন্দি রাখা সম্ভব ছিল, তাতে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কম হয়েছিল। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন রকম। তাদের কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা যাচ্ছে না, অনেকটা ইচ্ছামাফিক চলাফেরার সুযোগ ঘটছে তাদের। হয়তো শিথিল নজরদারি ও সংখ্যাধিক্যের কারণে এমনটি ঘটছে। শিথিলতার সুযোগ নিচ্ছে অনেকেই। কেউ মাদকের ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে, কেউবা জড়িয়ে পড়ছে চুরি-ডাকাতিতে। বর্তমান সময়ের আলোচিত মাদক ‘ইয়াবা’র উৎসস্থল মিয়ানমার। এরাও মিয়ানমারের অধিবাসী হওয়ায় সহজ হচ্ছে এ ব্যবসায় জড়ানো। স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ ধীরে ধীরে প্রবল হচ্ছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় তারা মুখ খুলতে শুরু করেছে। আকস্মিক ব্যাপক চাহিদার কারণে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, কাজে ভাগ বসাচ্ছে আশ্রিতরা। কক্সবাজারের পর্যটনকেন্দ্রিক জীবিকা যাদের তারাও উষ্মাবোধ করছেন পরিবেশ লন্ডভন্ড হওয়ার আশঙ্কায়।

চার.

এ কথা ঠিক যে, এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা সাধ করে আমাদের এখানে আসেনি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন করে এদের ঠেলে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ অভিমুখে। এটি ছিল সেখানকার সরকার ও সামরিক বাহিনীর সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। ঠেলে পাঠাবে বলেই নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত করে রেখেছিল রাখাইনের এই জনগোষ্ঠীটিকে। এর আগে দু-দুবার তারা একই কাজ করেছিল, কিন্তু টেকসই করতে পারেনি, ফেরত নিতে হয়েছে। এবার হয়তো পদক্ষেপ টেকসই হবে মনে করছে তারা। দুর্ভাগ্য এই যে, বাংলাদেশের কূটনীতি মিয়ানমারের কূটকৌশলের কিছুই আঁচ করতে পারেনি। অথচ সীমান্তবর্তী দেশের ভেতর মিয়ানমার সম্পর্কেই আমাদের সতর্ক থাকা উচিত ছিল সর্বাগ্রে; কেননা এরা কেবল রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেওয়া নয়, সেন্টমার্টিন নিয়েও সমস্যা করছে।

ঘটনা ঘটার দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে ইতোমধ্যে, বিশ্ব রাজনীতি থেকে প্রপঞ্চটি হারিয়ে যাওয়ার সময় হলো প্রায়। প্রত্যাবাসন নিয়ে দেশের মানুষ উদ্বেগবোধ করছে। দ্রুত প্রত্যাবাসন চায় সবাই। ক্ষুদ্র আয়তনের দেশ আমাদের, জনসংখ্যাও অস্বাভাবিক পরিমাণ। তার ওপর যদি চাপে অতিরিক্ত ১১ লক্ষাধিক লোকের বোঝা; সে তো উদ্বেগের কারণ হবেই। অতএব সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকুক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। কীভাবে সম্পন্ন হবে এই প্রত্যাবাসন; সে ব্যাপারে সরকারের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চয়ই আছে, তবে তারা তাকাতে পারেন অন্য মতামতের দিকেও। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে জোর আলোচনা হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মহলে। তারা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে ভারত, চীন ও জাপান। তিনটিই বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র। বন্ধু বন্ধুর বিপদে পাশে দাঁড়াবেÑ এমনটিই প্রত্যাশিত। কাছে টানার কূটনীতি এখন মুখ্য। তা ছাড়া উঠে আসা অন্য মতামতগুলোও খতিয়ে দেখতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। নিজেদের ভেতর বিভেদ নয়, ঐক্য দরকার জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিতে।

লেখক : কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close