আবু আফজাল সালেহ

  ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পর্যালোচনা

ঢাকার বাসযোগ্যতা ও বায়ুদূষণ

বিশ্বে সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের মধ্যে বসবাস অনুপযোগী শহরের তালিকায় ঢাকা তৃতীয়। যদিও গত বছর এ হিসেবে দ্বিতীয় ছিল বাংলাদেশের রাজধানীটি। তালিকাটির সবচেয়ে শেষে বা ১৪০তম যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া। প্রতি বছরের মতো এবারও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এ-সংক্রান্ত একটি তালিকা প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, বিশ্বের ১৪০টি শহরকে বাছাই করে বিভিন্ন বিষয়ের ভিত্তিতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অবস্থান র‌্যাংকিং করেছে ইআইইউ। শহরগুলোর রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা, অপরাধ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে এই সূচক প্রকাশ করেছে লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি। এটা আমাদের জন্য সুখের খবর নয়। বছরখানেক আগেও ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে খুব কম গবেষণা করা হয়েছে। ফলে প্রচারও কম হয়েছে। এখন আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু সেটাও কম আকারে। কোন সংস্থা পরিসংখ্যান বা গবেষণাপত্র প্রকাশ করলে কিছু লেখালেখি হয়। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা এখনো গ্রহণ করা যায়নি।

গত চার বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার একটি প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বসিয়ে ঢাকার বাতাসে দূষণ ও বিপদের মাত্রা, সেই সঙ্গে তাৎক্ষণিক করণীয়ও জানান দিয়ে আসছে। ইন্টারনেটে এটি রিয়াল টাইম এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) যেটাকে বাংলায় ‘সার্বক্ষণিক বায়ুমান সূচক’ হিসাবে অভিহিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানীর বায়ুদূষণ হার নিয়ে। বিশ্বে নির্ভরযোগ্য এ যন্ত্রের সূচকে দেখা ঢাকার বাতাসে দূষণ বা বিষের অবস্থা মারাত্মক অবস্থায়। ২৪ ঘণ্টায়ও ইতিবাচক সবুজ সূচকে আসছে না। বেশির ভাগ সময় বায়ুতে অতি বিপজ্জনক উপাদানের উপস্থিতি দেখাচ্ছে। এ নির্ভরযোগ্য যন্ত্রের মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় দশ হাজার শহরের বায়ুমান পরীক্ষা করা হয় বলে বিভিন্ন পত্রিকা সূত্রে জানা যায়।

বায়ুতে কয়েকটি রং ও বাতাসে ভাসমান ক্ষতিকর বস্তুকণার (যেমন ওজোন গ্যাস, হাইড্রোজেন সালফাইড, সিসা, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড) উপস্থিতির পরিমাণ দিয়ে। ভাবার বিষয় হচ্ছে, দুপুরের পর থেকেই ঢাকার বাতাসে বিপজ্জনক উপাদানের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এমনকি ছুটির দিনেও সবুজ সংকেতে আসছে না। বাতাসে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২.৫। ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে কম ব্যাসের অতিক্ষুদ্র এসব বস্তুকণার সহনীয় মাত্রা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। যদিও ঢাকার বাতাসে পাওয়া গেছে এর চেয়ে বেশি মাত্রায়। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য বলছে, ঢাকার বাতাসে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম ২.৫ ও পিএম ১০-এর মাত্রা গত বছরের চেয়ে বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইডের উপস্থিতিও। বায়ুর মান পরীক্ষায় নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (সিএএসই) প্রকল্পের আওতায় ঢাকা (৩টি), গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশালে কন্টিনিউয়াস এয়ার মনিটরিং স্টেশন (সিএএমএস) স্থাপন করেছে পরিবেশ অধিদফতর। তার ভিত্তিতে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে অধিদফতর। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের শেষ কয়েক মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দূষণের মাত্রা বাড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকা শহরের ছয়টি বিদ্যালয়ের শিশুদের ফুসফুসের কার্যকারিতা নিয়ে ২০১৬ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির আরবান ল্যাব। ফলাফলে দেখা যায়, বিদ্যালয়গুলোর ২৫ শতাংশ শিশুর ফুসফুস পূর্ণমাত্রায় কাজ করছে না। তাদের ফুসফুস ৬৫ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ করছে। কয়েক বছর ধরেই ঢাকার বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার ওপরে রয়েছে। ক্ষতিকর বস্তুকণার এ উপস্থিতি না কমে উল্টো বাড়ছে। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের তথ্য বিশ্লেষণেও দেখা যায়, ঢাকার বাতাসে অতিসূত্র বস্তুকণার পরিমাণ বেড়েছে।

বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৭ ভাগ। পরিবেশ দূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু, রোগী আর বৃদ্ধরা। শুধু বায়ুদূষণে ক্ষতি হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা শহরের ৬ লাখ মানুষ এখন সিসা দূষণের কবলে। ঢাকার পরই নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে বায়ুদূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ইটভাটাগুলো বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা ৩৪ ভাগ এবং মোটরযান ১৮ ভাগ দায়ী বলে উল্লেখিত সমীক্ষায় বলা হয়েছে। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, শুধু ঢাকাতেই এক বছরে ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশের শহরাঞ্চলে মারা গেছে ৮০ হাজার। পরিবেশ দূষণের সমন্বিত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনের ওপর।

স্বাস্থ্যবিদদের অভিমত হচ্ছে, বায়ুতে থাকা সিসা মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর একটা বিষয়। সিসার উপস্থিতির প্রভাবে মানুষ দ্রুত বুড়িয়ে যায়, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়। বিশেষ করে শিশুরা দুর্বল বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেড়ে ওঠে। এ ছাড়া বায়ুতে থাকা ক্ষতিকর বস্তুকণা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে ফুসফুস শক্ত হয়ে অক্সিজেন প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে ক্যানসারসহ নানা রোগ জন্ম নেয়। বাতাসে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত অতিসূত্র এ বস্তুকণা স্বল্প মেয়াদে মাথাব্যথা, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ নানা ব্যাধির জন্য দায়ী বলে জানান চিকিৎসকরা। এর প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুস ক্যানসার, কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অনেক অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন তারা। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি শ্বাসতন্ত্রের রোগ হয়। হাঁপানি রোগী হলে তাদের হাঁপানি বেড়ে যায়। আবার অনেকে নতুন করে হাঁপানি, শ্বাসতন্ত্রের অ্যালার্জি, হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত হয়। যক্ষ্মার মতো রোগগুলো বায়ুদূষণের কারণে বেড়ে যায়। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বেড়ে যায় নবজাতক ও শিশুদেরও। ফুসফুসের ক্যানসারের জন্যও দায়ী বায়ুদূষণ। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএলইউ বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতরের সঙ্গে যৌথভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা, সড়কের ধুলা, যানবাহন এবং বায়োগ্যাস পোড়ানোকে দায়ী করে তারা। ঢাকার বায়ুদূষণে ইটভাটা ৫৮ শতাংশ, সড়কের ধুলা ১৮ শতাংশ, যানবাহনের ধোঁয়া ১০ শতাংশ, বায়োগ্যাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণ ৬ শতাংশ দায়ী বলে জানানো হয়। ঢাকা মহানগরীর আশপাশে অনেক এলাকায় ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটার কারণে বাতাসে নানা ধরনের ধূলিকণা মিশে যায়। নির্মাণকাজের সময় নিয়ম না মেনে মাটি, বালুসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী দীর্ঘদিন যত্রতত্র ফেলে রাখা, রাস্তার দুপাশে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা সর্বোপরি যানবাহনের কালো ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করে তোলে। ফলে বাড়ছে সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা। এ অবস্থায় নাজুক অবস্থায় পড়ে শিশু আর রোগীরা।

ইট প্রস্তুতের ধরন ও আগে-পরের বিষয়/পদ্ধতি নিয়ে পূর্বের ইট প্রস্তুত আইন ২০১৩ সংশোধন করা হয়েছে। ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক পদ্ধতিকে যাতে প্রমোট করা হয়, আইনের বিভিন্ন ধারায় তা সংযোজন করা হয়েছে। মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির বিকল্প হিসেবে অপোড়ানো পদ্ধতি ব্লকের দিকে যেতে হবে। এজন্য আইনটি ব্যাপকভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু বড় চিন্তার জায়গা হলো নির্মাণকাজ। যে যেভাবে পারছে নির্মাণকাজ করছেন। এজন্য যুগোপযোগী আইন ও নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যত্রতত্র ও ‘যে যেভাবে পারে’ নির্মাণকাজে থেকে বিরত থাকার জন্য প্রশাসনকে বা কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু মুনাফার কথা নয়, ভেবে মালিক/সমিতি/ডেভেলপারেদের দেশ ও ভবিষ্যতের দিকেও লক্ষ রাখতে হবে। শুধু বিবেককে জাগ্রত করলে সরকারের কঠোর তদারকিও লাগবে না। অবশ্য এ ব্যাপারে মালিক-সরকারি কর্তৃপক্ষকেই বিবেক জাগ্রত করতে হবে।

ঢাকার অবস্থা খারাপ, তা প্রায় সবাই জানেন। তবে অতিমাত্রায় যে খারাপ ও তার ভয়াবহতা স¤পর্কে ঢাকাবাসীর খুব কম লোকই জানেন। গণমাধ্যমকে বেশি পরিমাণে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের দুর্দিনে গণমাধ্যমের ইতিবাচক অনেক ভূমিকা থাকে। এ বিষয়েও উচ্চকিত হবে দেশের গণমাধ্যম, তা আমরা আশা করি। ভয়াবহতার অবস্থা তুলে ধরে সচেতনতার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে করণীয় কী কী, তা তুলে ধরতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টিই পারে বিভিন্ন রকমের দূষণের ভয়াবহতা কমাতে। আইনও দরকার। পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। নগরায়ণে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে। সবুজ বিপ্লব দরকার। বনায়ন দরকার। পরিবেশবান্ধব শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে হবে। প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের আবাসস্থল আমাদের প্রিয় রাজধানী শহরকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের সবার।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close