আবু আফজাল সালেহ

  ১৯ জুলাই, ২০১৯

বিশ্লেষণ

বিচার ব্যবস্থাই ধর্ষণ রোধের প্রধান নিয়ামক

যুদ্ধের সময়ও নারী-শিশুদেরকে নিরাপদে রাখতে লিখিত-অলিখিত আইন, চুক্তি আছে। পারস্পরিক শত্রুপক্ষের এ দুটোর ব্যাপারে সহিংসতা এড়াতে বলা হয়েছে। গৃহযুদ্ধ বা অন্য দেশ কর্তৃক সামরিক দখলের সময় নারী ও শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়। যুদ্ধসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ যখন গৃহহারা হয়, রিফিউজি হয়; তখনো নারী-শিশুদের ধর্ষণের আশঙ্কা ভয়াবহ পরিমাণে থাকে। ১৯৭৭ সালে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনে আর্টিক্যাল-২৭ যুদ্ধ ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে কার্যকরী ঘোষণা করে। আর বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে শিশু নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ। নারী ধর্ষণের হার লাগামের বাইরে। কোনো অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না! পৃথিবীজুড়ে বাড়ছে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণের মতো ঘটনা। সেই সঙ্গে চাইন্ড পর্নোগ্রাফি এবং চাইল্ড ট্রাফিকিং বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এর প্রভাব বেশ মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। সাম্প্রতিক সময়ের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি ধর্ষণ বিশেষ করে শিশু ধর্ষণ চরম আকার ধারণ করেছে আমাদের দেশসহ পুরো বিশ্বে।

মিডিয়ায় দেখা যায়, প্রতিদিন অনেক ধর্ষণের ঘটনা। শিশুদের ধর্ষণের হার বেড়ে গেছে। অপরাধীরা বেপরোয়া। প্রভাবশালীদের অনুক¤পাও পাচ্ছে অনেক অপরাধী। ধর্ষণে জড়িত শুধু বখাটেরা নয়; আছে স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক, কোচিং শিক্ষক, পীর নামধারী কিছু লম্পট, জিন তাড়ানোর ওঝার বেশে অপচিকিৎসক; আছে মসজিদের ইমাম, দলীয় পরিচয়ধারী কপট-দুর্বৃত্ত। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে দুই হাজারের বেশি নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৩১ জন। দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের হারও অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। বলা যায়, নৈতিক অবক্ষয়ের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সমাজের পচন ধরেছে এবং তা দেহে বিস্তৃতি লাভ করেছে।

২০১৮ সালের আগস্টে ‘ফার্স্টপোস্ট’ অনলাইন ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারে গবেষক মধুমিতা পান্ডে বলেছেন, ধর্ষণকারীদের পশু বলা, জানোয়ার বলা, দানব বলা সমস্যার সমাধান নয়। তাতে হয় কী, আমরা সমাজের ভালো মানুষ, আমরা রেপের জন্য দায়ী নই, আর ওরা হলো জন্তু-জানোয়ার, ওরা দায়ীÑ এ রকম একটা সহজ দায়মুক্তির ধারণা সমাজে চলে আসে। মধুমিতা বলেছেন, ‘ধর্ষণ একটা লম্বা সুতা, যার এক প্রান্তে আছে ধর্ষণ নামের ক্রিয়াটি। কিন্তু এটা শুরু হয়েছে সমাজের আরো অনুষঙ্গ থেকে, নারীকে অধস্তন হিসেবে দেখা, ইভ টিজিং, নারীবিদ্বেষী কৌতুক, নারীকে তাচ্ছিল্য করে কথা বলা, হয়রানিÑ এ ধরনের কম গুরুতর বলে বিবেচিত উপাদানগুলোই শেষতক ধর্ষণে গিয়ে পৌঁছায়।’ অবহেলা, আবেগে সাহায্য-সহযোগিতা, বিবেকের লোপ টেনে ইত্যাদি নেতিবাচকতা অপরাধীদের বাঁচিয়ে দিচ্ছে। রিফাত হত্যার পর আদালতের কথাটি প্রণিধানযোগ্য। ‘ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। সমাজটা কোথায় যাচ্ছে? দাঁড়িয়ে দেখেছে, কেউ প্রতিবাদ করল না। অন্তত পাঁচজন মানুষ এগিয়ে এলে হয়তো তারা সাহস পেত না। জনগণকে আপনি কী করবেন? বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন ছিল না। ভিডিও করল, কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। এটি জনগণের ব্যর্থতা।’ সত্যই তাই। জনগণই ব্যর্থ। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, অপরাধীর পক্ষে উকিল দাঁড়িয়ে গেলে বিচার প্রক্রিয়া ঘোলাটে হয়ে যায়। কিন্তু সাহায্যে এগিয়ে না এসে ভিডিও করা, সেটা ছড়িয়ে দেওয়া। তাই হচ্ছে বাংলাদেশে।

ন্যায়বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধর্ষণ বিস্তারের প্রধাণ কারণ। বিচার ব্যবস্থাই ধর্ষণ রোধের প্রধান নিয়ামক বলে মনে করি। বিলম্বিত বিচার ধর্ষণের সারি শুধু লম্বা করবে। সমাজবিজ্ঞানী জনাথান হ্যাইট বলেন, ধর্ম, ঐতিহ্য ও মানব আচরণÑ এ তিনটি বিষয়ে নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এবার আমরা দেখি আমাদের প্রেক্ষাপট। ধর্মীয় বিষয়ে আমরা একেবারেই অসহিষ্ণু! অন্য ধর্মের বিষয়ে আমরা সহ্য করতে পারি না! সত্য-মিথ্যার ধার ধরি না! আমাদের ঐতিহ্যের অনেক কিছু আজ অন্য জাতি কর্তৃক দখল হয়ে যাচ্ছে বা গেছে। আর মানব আচরণ ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে! এসব কিন্তু ভয়াবহতার কথাই বলবে। নেগেটিভ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে; যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। আর নৈতিকতা হচ্ছে ধরন বা ভালো আচরণ। মানসিক অবস্থা যা অপরের মঙ্গল কামনা করে বা করতে অনুপ্রেরণা দেয়। আর মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী ধারণা বা আদর্শ। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী স্টুয়ার্ট সি ডাজ বলেছেন, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে ওইসব রীতিনীতির সমষ্টি, যা ব্যক্তি সমাজের কাছ হতে আশা করে এবং যা সমাজ ব্যক্তির কাছ হতে লাভ করে।’ আলোচনা করলে দেখা যাবে, এদিকে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সমাজটা কত দূর এগিয়েছে? সামাজিক শৃঙ্খলা, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা আমাদের যাপিত জীবনে কতটা অর্জিত হয়েছে। সমাজে কতটা অপরাধপ্রবণতা কমেছে, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজটা কতটা নিরাপদ, সমাজ কাঠামো কতটা উন্নত হয়েছে, সার্বিক বিবেচনায় আমাদের সমাজটা নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধের দিক থেকে কতটা এগিয়েছেÑ আজ এ প্রস্তাবগুলোর উত্তর বিচার-বিশ্লেষণ করা খুবই জরুরি বলে মনে করছেন সমাজ বিশ্লেষকরা।

লোভ, ন্যায়বিচার, বৈষম্য, নৈতিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদি অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে, ফলে আত্মহত্যা ও হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলছে। পারিবারিক কলহ, যৌনাচার, অশীলতা, ধর্ষণ, খুন, ইভ টিজিং, অ্যাসিড সন্ত্রাস, শিশু হত্যা-নির্যাতন, মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, স্বজন, বন্ধুবান্ধব সামাজিক সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোতে ফাটল ধরছে, ঢুকে পড়ছে অবিশ্বাস। ফলে বাপ-মায়ের হাতে সন্তান বা বিপরীত, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, আত্মীয়স্বজনের কাছ হতে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে; যা সমাজ অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। সবচেয়ে বেশি অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে যুবসমাজ, যারা একটি দেশ বা জাতির ভবিষ্যৎ। তারা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে, হয়ে যাচ্ছে বখাটে, মদ্যপ, ধর্ষক ও সন্ত্রাসী। এগুলো সামাজিক অবক্ষয়ের চরম ও হতাশাজনক চিত্র!

ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি বা বৃদ্ধি এ অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে! এ ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের অধিক প্রচার করতে হবে। শিক্ষকরা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। তারা ক্লাস বা বাইরে মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। আবার সাংবাদিক বা লেখকরা পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম। এ ব্যাপারে তারাও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। অপরাধের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে আমাদেরকে বা প্রশাসনকে। অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বা দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে এসব বিচার করা যেতে পারে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত বা নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করতে পারে সরকার। অবশ্য অপরাধী ধরতে আমাদের শতভাগ সাহায্য ও সহযোগিতা করতে হবে। তদুপরি কঠোর ও শক্তিশালী আইন প্রণয়ন এবং তার কঠোর প্রয়োগ অবক্ষয় বা বিকৃত এ রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে! যেন আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে অপরাধীরা পার না পায়; সে বিষয়ে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে!

অপরাধীদের দমন, অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা দরকার। স্বাধীন দেশে কোপাকুপি আর ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য, লজ্জাজনক ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। পচন শুরু হয়েছে। পচন থেকে কেউ রেহাই পাবে না! দুর্গন্ধ ছড়াবেই! আমরা চাই, আইনের প্রয়োগ না করেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে নারী নির্যাতনের হার প্রায় জিরোতে আনতে। অবশিষ্ট হার আইনের প্রয়োগে সমাধান করতে হবে। এজন্য সরকার-জনগণ-নারী সমাজসহ সবস্তরের লোকজনকে এগিয়ে আসা। তা হলেই স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close