নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৪ মে, ২০১৯

আলোচনা

কৃষক বনাম ধানের ন্যায্যমূল্য

ধান নিয়ে সারা দেশে চলছে এক তুলকালাম কান্ড। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের নিজ জেলা টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার আবদুল মালেক শিকদার নামের এক কৃষক ধানের দাম কম ও কৃষিশ্রমিকের বেশি মজুরির প্রতিবাদে ক্ষোভে-দুঃখে নিজের পাকা ধানখেতে আগুন দিয়ে এক অভিনব পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তার এই প্রতিবাদের খবরটি সারা দেশের পত্রপত্রিকায় গুরুত্বসহকারে প্রচারিত হয়। এতে দেশের বিভিন্ন কৃষক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। দাবি উঠছে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান কেনার। প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন। প্রয়োজনে বেসরকারি গুদাম ভাড়া করা। চাল আমদানি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখা। চাল আমদানির ওপর শুল্ক বৃদ্ধি। উদ্বৃত্ত চাল বিদেশে রফতানি করা ইত্যাদি।

প্রতি মণ ধানের দাম কম পক্ষে ১ হাজার ১০০ টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। গত ২০ মে এ উপলক্ষে রাজশাহীর কোর্ট শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে এ দাবি জানানো হয়। সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে কৃষকের কমপক্ষে ৯ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়। তাই ধানের দাম ১ হাজার ১০০ টাকার নিচে করা যাবে না।’ রাজশাহীর প্রতিটি ইউনিয়নে জরুরিভিত্তিতে সরকারিভাবে ধান কেনা, কৃষকের ধান বিক্রি নিশ্চিত, আগামী মৌসুমে কৃষকদের বিনামূল্যে সার, বীজ ও কীটনাশক সরবরাহ, নতুন খাদ্যগুদাম নির্মাণ করে উৎপাদিত শস্যের ১৫ ভাগ মজুদ এবং গুদামে অসাধু কর্মকর্তা- কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য বন্ধের দাবিতে সমাবেশ থেকে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার উজানপাড়া গ্রামের প্রবীণ ধান ব্যবসায়ী ও আড়তদার গোলাম মোস্তফা বলেন, গত ২০ মে তার আড়তে ৬২০ টাকা মণ (৪০ কেজি) দরে ব্রিধান-২৮ এবং ৫০০ টাকা মণ দরে ব্রিধান-২৯ ও হাইব্রিড জাতের ধান কেনা হয়েছে। গত বছর এ সময় প্রতি মণ বোরো ধানের দাম ছিল ৭০০ টাকা। তার হিসেবে বর্তমানে প্রতি মণ ব্রিধান-২৮ থেকে ২৫ কেজি ও ব্রিধান-২৯ থেকে ২৪ কেজি চাল পাওয়া যাচ্ছে। ময়মনসিংহের বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতি কেজি নতুন বোরো চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। সে হিসেবে ২৫ কেজি চালের দাম ৭৫০ টাকা। মণপ্রতি উৎপাদন খরচ ২৫ টাকা ও ব্যবসায়ীদের লাভ ২৫ টাকা বাদ দিলেও কৃষকের কাছ থেকে প্রতি মণ বোরোধান কমপক্ষে ৭০০ টাকা দরে ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা অনায়াসে ক্রয় করতে পারেন। কিন্তু ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ধান কিনে কৃষকের সর্বনাশ করছেন। ব্যবসায়ীরা গত দুই বছরে দেশে ধানের বাম্পার ফলন হওয়া সত্ত্বেও ৬০ লাখ টন চাল আমদানি করে গুদাম ভর্তি করে রেখেছেন কার স্বার্থে? সরকারের উচিত ছিল কৃষকের স্বার্থে আজ থেকে ৬ মাস আগেই বিদেশ থেকে চাল আমদানি বন্ধ বা সীমিত করা।

সূত্রমতে, দেশে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত আছে এবং সরকারি গুদামে মজুদ আছে প্রায় ১২ লাখ টন চাল। সারা দেশে ১৬ হাজার চাল কলের মধ্যে মাত্র ১ হাজার চালু আছে। বাকি চাল কলের মালিকরা বোরো ধানের এই ভরা মৌসুমে কী কারণে চালকলগুলো বন্ধ রেখেছেন; তা আমাদের বোধগম্য নয়। এর পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে কি না, কে জানে? কারো কারো সন্দেহ, প্রতিবেশী দেশ থেকে আমদানি করা গুদাম ভর্তি চাল বস্তা বদল করে সরকারি গুদামে ঢোকানোর পরই মিল মালিকরা তাদের চাল কলগুলো চালু করবেন। তখন কৃষকের ঘরে কোনো ধান থাকবে না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদিত কৃষকের কষ্টের ধান চলে যাবে মহাজনদের গুদামে। লোকসানে সর্বস্বান্ত হবেন কৃষক। কৃষিকাজের প্রতি প্রচন্ড অনাগ্রহ সৃষ্টি হবে মানুষের।

এখন সারা দেশে চলছে বোরো ধান কাটার উৎসব। ধান কাটা, মাড়াই শুকানো কাজে কৃষাণ-কৃষাণিরা ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। সারা দেশের হাটবাজারে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। আর ধান কাটার শ্রমিকের দৈনিক মজুরি দিতে হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। অর্থাৎ দেড় মণ ধান বিক্রি করে একজন কৃষিশ্রমিকের এক দিনের মজুরি পরিশোধ করতে হচ্ছে। তার পরও দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের তিন বেলার খাবার। এদিকে বাজারে ধানের দাম কম অন্যদিকে শ্রমিকের অধিক মজুরির কারণে কৃষক পড়েছে মহাসংকটে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে উৎপাদিত ফসলের ১৫ শতাংশ সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হয়। আমাদের দেশে উৎপাদিত চালের মাত্র ৪ ভাগ সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হয়। সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতার অভাবের কারণেও সরকারিভাবে বেশি পরিমাণে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে দেশে ১ কোটি ১০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হতো। তখন সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা ছিল ১৫ থেকে ১৬ লাখ টন। বর্তমানে দেশে চাল উৎপাদিত হয় ৩ কোটি ৬৩ লাখ টন। আর সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা মাত্র ২১ থেকে ২২ লাখ টন, যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি খাদ্যগুদামের ধারণক্ষমতা ৫০ লাখ টনে উন্নীত করে চালের পরিবর্তে উৎপাদিত ধানের শতকরা ১৫ ভাগ সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সরকারিভাবে ক্রয় করা উচিত। এতে কৃষক উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং টেকসই হবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা।

চারা রোপণ, ধান কাটা ও মাড়াই কাজে ধান ফসলের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ শ্রমশক্তি ব্যবহার করা হয়। এ কাজগুলো যদি যন্ত্রের সাহায্যে সম্পন্ন করা যায়, তা হলে ধানের উৎপাদন খরচ অনেক হ্রাস পাবে। কৃষক লাভবান হবেন এবং কৃষিশ্রমিক সংকট দূর হবে। এজন্য সরকার কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সারা দেশে ক্রয়মূল্যের শতকরা ৫০ ভাগ এবং হাওর অঞ্চলে শতকরা ৭০ ভাগ ভর্তুকি প্রদান করছে। কম্বাইন হার্ভেস্টারের মাধ্যমে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাভর্তি কাজে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খরচ সাশ্রয় করা সম্ভব। অন্যদিকে রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণের মাধ্যমেও ধান চাষের উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়ে আনা যায়। এ ছাড়া অধিক লাভের জন্য কৃষক ভাইদের মোটা ধানের পাশাপাশি উন্নত জাতের সুগন্ধি ধানের চাষ করা উচিত। কারণ সুগন্ধি ধানের উৎপাদন খরচ কম, বাজারে চাহিদা বেশি এবং দাম সাধারণ ধানের দ্বিগুণ। সুগন্ধি চালের বিদেশে রফতানির সম্ভাবনাও রয়েছে প্রচুর। দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, বিরল, বোচাগঞ্জ ও কাহারোল উপজেলার অধিকাংশ কৃষক মোটা ধানের পাশাপাশি ব্রিধান-৩৪ জাতের সুগন্ধি ধানের চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছেন।

ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। ধান উৎপাদনের সঙ্গে দেশের ১ কোটি ৫২ লাখ কৃষি পরিবার ও ২ কোটি ৪৭ লাখ জনশক্তি জড়িত। ধানের উৎপাদন, লাভ-ক্ষতি ও ন্যায্যমূল্যের ওপর শুধু কৃষকের ভাগ্য জড়িত নয়; দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নও ওপ্রোতভাবে জড়িত। ধানের দাম কম হলে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফলন বিপর্যয় ঘটলে; তার প্রভাব পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে। কৃষক কষ্ট করে লাভের আশায় ধান চাষ করেন। সেই ধান বিক্রি করে যদি তার প্রতি মণে দেড় থেকে দুইশ টাকা লোকসান গুনতে হয়, তা হলে কী জন্য তিনি করবেন ধানের চাষ? এ প্রশ্নের উত্তর সরকারের নীতিনির্ধারকদের খুঁজে বের করতে হবে। ধানের ন্যায্যমূল্যের সঙ্গে এ দেশের কৃষকের বাঁচা-মরার সংগ্রাম নিহিত। তাই ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারকে জরুরিভিত্তিতে চাল আমদানি বন্ধ, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় এবং উদ্বৃত্ত চাল (যদি থাকে) রফতানিসহ বিভিন্ন কৃষিবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা আড়াই থেকে তিন গুণ বাড়াতে হবে।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি., নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close