রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৫ এপ্রিল, ২০১৯

পর্যালোচনা

সুদানের স্বৈরশাসক পতনের নেপথ্যে

উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশ সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির পদত্যাগ করেছেন। সে দেশের সামরিক বাহিনী ও জনগণের প্রতিবাদের মুখে তিনি পদত্যাগ করেন। এদিনই দেশটিতে সেনাবাহিনীর দেওয়া এক খসড়া অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে বলে একটি সামরিক সূত্র জানায়। ১১ এপ্রিল সকালেই সুদানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও রেডিওতে বলা হয়, ‘সেনাবাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দেয়। এরপর বশিরের পদত্যাগের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দুই কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকের অপমানজনক পতনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্রাসেলসে অবস্থিত অলাভজনক সংগঠনে অতিথি বিশেষজ্ঞ মার্ক পিয়োধনি বলেছেন, আলজেরিয়া ও সুদানের প্রেক্ষাপটের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দেশ দুটির ঘটনা থেকে বিশ্বের সব একনায়ক ও স্বৈরশাসকের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হলোÑ ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র আর সবার জন্য সমান সুযোগের ক্ষুধা সর্বজনীন। দেশ দুটির একনায়ক শাসকদ্বয় জনগণের সর্বজনীন অধিকার অস্বীকার করে কঠোর নিপীড়নমূলক শাসন কায়েম করেছিল। আর রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের সব কিছুর ওপর ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ পকেটে পুরেছেন। স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ এসব দেশের জনগণ তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নেমে এসেছিল সর্বপ্রকার ভয়ভীতি উপেক্ষা করে। সরকারি বিভিন্ন বাহিনী আন্দোলনকারী বিক্ষোভরতদের ওপর গুলিবর্ষণ করেছে, মানুষ হত্যা করেছে, তথাপি রাজপথ ছেড়ে আসেনি বিক্ষোভকারীরা।

এ ছাড়া আন্দোলনকারীদের এই অনমনীয়তা এবং অদম্য সাহসিকতার কারণেই প্রাথমিক বিজয় নিশ্চিত হয়েছে স্বৈরশাসকদের পতনের মধ্য দিয়ে। পিপলস পাওয়ার বা জনগণের শক্তি যে অপ্রতিরোধ্য; সেটা আবারও প্রমাণিত হলো সুদান এবং আলজেরিয়াতে। জনগণের প্রচন্ড বিক্ষোভের মুখে দীর্ঘমেয়াদের স্বৈরশাসক, যথাক্রমে সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর হাসান আল বশির এবং আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকা ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। উল্লেখ্য যে, বশির ৩০ বছর এবং বুতেফ্লিকা ২০ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বুতেফ্লিকা এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে বশির ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে জনগণের শক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেন। রাষ্ট্র ও সম্পদের ওপর জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার অস্বীকার করা এবং জনগণের শক্তির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্র শাসন করার ফলে শাসকদ্বয়ের মধ্যে যে দম্ভিকতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল, সেটি গুঁড়িয়ে দিয়ে দেশ দুটির জনগণ প্রমাণ করে দিয়েছে, জনগণের ক্ষমতাকে অস্বীকার করে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, মননশীলতার অধিকার, সরকার নির্বাচন ও সরকার পরিবর্তনে জনগণের অধিকার ইত্যাদি মৌলিক মানবিক অধিকারসমূহ এবং ন্যায়বিচার ব্যবস্থার নিশ্চয়তা করার অধিকারগুলোকে অনন্তকাল ধরে দমন করে রাখা যায় না বা অস্বীকার করা সম্ভব হয় না। সাময়িককালের জন্য মানুষকে ভয় দেখিয়ে, নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচার করে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা সম্ভব হলেও চূড়ান্ত বিচারে মানুষকে স্থায়ীভাবে স্তব্ধ করে রাখা যায় না।

উল্লেখ্য, স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মূল শক্তি ছিল দেশের ছাত্র ও যুবসমাজ। যুবকদের ব্যাপক অংশগ্রহণই বশিরবিরোধী গণ-আন্দোলনকে বিজয়ের পথে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এর থেকে আবারও প্রমাণিত হলো, যুবসমাজকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে না পারলে গণবিক্ষোভ সফল করে তোলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ গণবিক্ষোভ আরো প্রমাণ করে যে, শাসক যদি তার জনগণকে সন্তুষ্ট রাখতে না পারেন; যদি জনগণের গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নির্বিশেষে জীবনমানের জন্য অপরিহার্য অধিকারগুলো অস্বীকার ও অবজ্ঞা করে কেবলমাত্র অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের মাধ্যমে জনগণকে ভয়ের মধ্যে রেখে শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়; তবে সেক্ষেত্রে স্বৈরশাসক নিজেকে খুব বেশি সময় ধরে নিরাপদ রাখতে সক্ষম হবে নাÑ জনগণের রুদ্ররোষই তার পতন অনিবার্য করে তুলবে। কারণ গণশক্তি এ সময় জেগে উঠবেই। এ আন্দোলনের আরো একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং জীবনমানের ক্রম অবনতির প্রতিবাদে গণবিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল; সেটাকে ‘ব্রেড রায়টস’ বলে অভিহিত

করেছিল বিশ্বের গণমাধ্যমসমূহ। তা কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক বিক্ষোভ-আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি;

অতি দ্রুতই অর্থনৈতিক আন্দোলন তথা ব্রেড রায়টস, রাজনৈতিক বিক্ষোভে পরিগণিত হয়েছিল। এমনকি আন্দোলনকারীরা, এ আন্দোলনকে ২০১১ সালের আরব বসন্তখ্যাত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে স্বৈরশাসক বশিরের পদত্যাগ দাবি করে।

স্বাধীনতা, মুক্তি, শান্তি ও ন্যায়বিচারের দাবিতে সেøাগান ধরেছিল রাজপথে। জনগণের এ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরতান্ত্রিক একনায়ক শাসক ওমর হাসান আল বশিরের জন্য বড় ধরনের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনতর কোনো চ্যালেঞ্জ বিগত ৩০ বছরের মধ্যে মোকাবিলা করতে হয়নি এ স্বৈরশাসককে। তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক নির্বিকার বসে থাকেননি বরং আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করে নিজের শাসনকে দীর্ঘায়ু করার জন্য অতি নৃশংসভাবে বিক্ষোভকারী জনতার ওপর তার নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবমতে, আন্দোলনের প্রথম পাঁচ দিনেই নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ৩৭ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের সর্বপ্রকার সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে আন্দোলনের সমর্থক ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিভিন্ন পেশাজীবী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি আন্দোলন সংশ্লিষ্টদের টার্গেট করে অভিযান চালিয়ে ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে তাদের ওপর জঘন্য ধরনের নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন করেও আন্দোলন দমন করতে পারেনি বশিরের একান্ত সব নিরাপত্তা বাহিনী। অপরদিকে আন্দোলন দমনে বশির বাহিনী যতই কঠোর দমননীতি অব্যাহত রাখে; ততই গণ-আন্দোলনের পরিধি আরো ব্যাপকতা লাভ করে লাখ লাখ মানুষ আন্দোলনের তপ্ত রাজপথে নেমে আসতে থাকে এবং একসময় এ বিক্ষোভ আন্দোলন গণবিপ্লবে পরিণত হয়।

সুদানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, সর্বস্তরের সব বয়সের মানুষ একাত্ম হয়েছিল আন্দোলনে। মানুষ তাদের জীবনমানের উন্নতি, প্রকৃত স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে সেøাগান তুলে ৩০ বছরের একনায়ক ও স্বৈরশাসক বশিরকে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে রাজপথে অবস্থান নিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ভবন ও সেনাছাউনি অবরুদ্ধ করে রেখে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ে সচেষ্ট থেকেছে। সুদানের এ গণ-আন্দোলনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। যেমনÑ রুটির দাম, তেলের দাম ইত্যাদি নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রতিবাদে রাজধানী শহর থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরের বিখ্যাত লেবার মুভমেন্টখ্যাত রেলওয়ে শহর আটবারায় ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল এবং অল্প সময়কালের মধ্যেই এ আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে দেশের রাজধানী শহর খার্তুম, পোর্টসুদান আল গাদারিফসহ ২৮টি শহর ও সিটিগুলোতে এবং দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী শহরগুলোতে। অর্থাৎ সারা দেশের বিস্তৃত জনপদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। আর এ বিক্ষোভ-আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন পুলিশের গুলিতে নিহত তরুণ চিকিৎসক ডা. বাবিকীর। এই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ডা. বাবিকীর ১৭ জানুয়ারি ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট বশির সমর্থক নিরাপত্তা কর্মীদের গুলিতে রাজপথে নিহত হয়েছিলেন এবং তার এ মৃত্যু আন্দোলনকে চূড়ান্ত উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। এই বিক্ষোভ-আন্দোলনের অন্যতম একটা লক্ষণীয় বিষয় হলোÑ নেতৃত্ব কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে ছিল না।

বরং সুদানিজ প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশন বা এসপিএ নামক পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারে ও নেতৃত্বে এ আন্দোলন সংঘটিত ও পরিচালিত হয়েছিল। এবং এই সংগঠনটিতে যুক্ত হয়েছিল চিকিৎসক সংগঠন, আইনজীবী সংগঠন, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক সংগঠনসমূহ এবং বিভিন্ন অন্য পেশাজীবীরা এবং আরো যুক্ত হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো। এসব মিলেই একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল প্রেসিডেন্ট বশিরের বিরুদ্ধে এবং বিশ্লেষকদের অভিমত, সরকারবিরোধী আন্দোলনের মূল শক্তিই ছিল চিকিৎসক গোষ্ঠী। সম্প্রতি দেশটিতে রাজনৈতিক বিক্ষোভ জোরালো হয়ে ওঠে। সরকার তেল ও রুটির দাম বাড়ানোর পর তার ৩০ বছরব্যাপী শাসনামলের মধ্যে গত ডিসেম্বরে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ শুরু হয়। কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিকভাবে সংকটে ভুগছে সুদান, বিশেষ করে দক্ষিণ সুদান আলাদা হয়ে যাওয়ার পর। কারণ দেশের মোট উত্তোলিত তেলের চার ভাগের তিন ভাগই রয়েছে দক্ষিণ সুদানে। মুদ্রামান কমে যাওয়া ও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েছে দেশের মানুষজন। বশিরের শাসনামলে দেশটি ২০১৮ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির তালিকায় ১৮০ দেশের মধ্যে ১৭২ নম্বরে রয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি এক বছর মেয়াদি জরুরি অবস্থা জারি করেন বশির। তার মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আনেন এবং দেশের সব স্টেট সরকারের গভর্নরদের সরিয়ে দিয়ে সেখানে সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বসিয়ে দেন। কোনো অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের দাবিও নাকচ করে দেন। তার দাবি, বিক্ষোভকারীরা ২০২০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তাকে সরিয়ে দিতে পারবে। এমনকি বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ উঠে সরকারের বিরুদ্ধে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close