চৌধুরী মনজুর লিয়াকত

  ২১ মার্চ, ২০১৯

মতামত

সংশোধিত হোক ব্যাংকিং খাত

বিআইবিএম-এ অনুষ্ঠিত ‘ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতা’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান হলো গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। নৈতিকতা বিষয়ে ১৮তম নুরুল মতিন মেমোরিয়াল লেকচার এটি। ১৯৯৭ সাল থেকে যা চলে আসছে এ ইনস্টিটিউটে। এবারেরটি উপস্থাপন করলেন বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর (ভারত) ড. জুনায়েদ কামাল আহমেদ। যিনি জন্মগতভাবে বাংলাদেশের একজন অর্থনীতিবিদ। তার বক্তব্যের প্রথমেই জীবন থেকে নেওয়া দুটো উদাহরণ দিলেন। একটি মসজিদে জুতা চুরি আরেকটি পরীক্ষার আগে ছোটবেলায় প্রশ্নপত্র পাওয়ার এডভেঞ্চারের বিষয়। এ বিষয়ে বললেন, যদি মসজিদের মতো পবিত্র জায়গায় এ রকম হয়, তা হলে সার্বিক অর্থে একটি বৃহৎ দায়িত্বশীল পরিবেশে নৈতিকতার চর্চাটি ঠিক রাখা বেশ কঠিন। আসলে অর্থনীতিসহ সার্বিকতায় অনৈতিকতা স্থান দখল করে নিচ্ছে অনবরত। তার ভাষায়, ‘Something Fundamentalz Wrong’ মূলেই বোধহয় রয়েছে সমস্যা।

একটি রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিকভাবে চলতে দেওয়াটা জরুরি। তিনি এর আগের দেওয়া নৈতিকতা বিষয়ের ১৭টি বক্তব্য অধ্যয়নের অভিজ্ঞতায় বলছেন, ‘নৈতিকতা প্রয়োজনীয়’ এটি বেরিয়ে এসেছে সবকটিতেই। তবে ব্যাংকিং সিস্টেম অর্গানাইজ করার ক্ষেত্রে নৈতিকতা একটি একক প্র্যাকটিক্যাল ডিজাইন অপশন বা দিকনির্দেশনা দিতে পারছে না বাস্তবতায়, খুব নির্দিষ্ট এবং পরিষ্কারভাবে। বিশ্বের স্বনামধন্য একটি সার্ভেতে উঠে এসেছে যে, আর্থিক খাতটি সবচেয়ে কম বিশ্বাসযোগ্য একটি খাত, পৃথিবীব্যাপীই। তাই এখানে অনেক গভীরে যাওয়া জরুরি। ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমের নীতিনির্ধারকরা এবং বিশেষজ্ঞরা নৈতিকতাকে খুব ধর্তব্যে নিচ্ছেন না অথবা এড়িয়ে যাচ্ছেন। ইমানুয়েল কান্টের একটি কথা এখানে উল্লেখ করেন তিনি, ‘Ethics is Judged bz Intent not bz outcome’।

আর ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. রেড্ডির উদাহরণ দিয়ে বলেন, ক্রেডিট শব্দটি এসেছে ল্যাটিন বিশ্বাস (Trust) শব্দটি থেকে। এটি এক দিনে সৃষ্টি হওয়ার কোনো বিষয় নয়। এটা জীবনব্যাপী নির্মীয়মাণ একটি কর্ম। ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকারদের ব্যর্থতা অর্থাৎ ইউএসএর ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমের ঘাটতি বিশ্ব মন্দা বা গ্লোবাল ক্রাইসিস সৃষ্টি করে পুরো পৃথিবীকে নাড়া দেয় কয়েক বছর আগে (২০০৮-১০)। এ অনৈতিক ব্যর্থতাকে বেইল আউট করার কাজটিকে আমেরিকার সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এ ব্যাপারেই ইংল্যান্ডের ক্যান্টারবেরির আর্চ বিশপ জাস্টিনের একটি পপুলার হওয়া উক্তি উল্লেখ করেন তিনি। ব্রিটেনের রানি আর্থিক বিশেষজ্ঞদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিশ্ব মন্দায় আর্থিক ব্যবস্থার পতনের কারণ কী? তখন সবাই বহু রকম তাত্ত্বিক ব্যখ্যা দেন যে, এর কারণ হয়তো ইন্টারেস্ট রেট, করপোরেট গভর্ন্যাস ব্যর্থতা, মার্কেট ফেইলিউর ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশপ জাস্টিন তখন বলেন, এ ব্যাখ্যাগুলো এমন যেন কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন যে, টাইটানিক ডুবেছে কেন? আর এর উত্তর হয়, ‘খুব বেশি পানি ঢুকেছিল যে’। আসলে সত্যিকারের কারণ সন্ধান করতে হবে আর্থিক ব্যবস্থাগুলো পর্যবেক্ষণে, ভাসা ভাসা বিশ্লেষণে হবে না সত্যিকারের আলোকিত সমাধান।

গ্লোবাল ক্রাইসিস হলো সমগ্রভাবে সামাজিক ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার পরও ব্যর্থতা সৃষ্টিকারী বিজনেস গ্রুপের সঙ্গে এস্টাবলিশমেন্টের রাজনৈতিক সংযোগ ঘটে চলে পরবর্তী সময়েও অহরহ। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও থাকেন তারা কাছাকাছিই হাস্যোজ্জ্বল। যেন ওদের কোনো ব্যর্থতা নেই, তেমন একটা ছবি ভাসে আর ঠিক এভাবেই ছড়ায় সেটা সাধারণের মাঝে। এখানে চলে আসে সামাজিকভাবে বয়কটের বিষয়টি।

দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থা অনৈতিকতা, দুর্নীতি, ধোঁকা দেওয়াকে প্রশ্রয় দেয়। এটার সমাধানে তিনটি বিষয় চিন্তা করা যায়। এর মধ্যে প্রথমত, ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্রোচে ব্যাংকিংয়ে করপোরেট গভর্ন্যান্স শুদ্ধ করার বিষয়টি আসে। অন্য ক্ষেত্রে মার্কেট সিন্ড্রোমটি ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে মার্কেট ফেইলিউরকে দোষ দেন। এখানে তথ্য আর বাইরের প্রভাবকে ধর্তব্যে নিতে হবে। বাজার যেন ব্যাংকিং সিস্টেমকে চালনা করতে না পারে, এটি দেখতে হবে। আর সহজে যেহেতু নৈতিকতার চর্চা চালু করা কঠিন, এজন্য আর্থিক ব্যবস্থায় পাবলিক পলিসি ও রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক শক্ত করতে হবে। এর সঙ্গে চলে আসে পাবলিক পলিসি এবং অসম্পূর্ণ রেগুলেটরি ব্যবস্থা। সরকারের একটি ব্যর্থতা হিসেবে যেহেতু অবশেষে চিহ্নিত হয় এটি, তাই বিষয়টি জরুরি। তাত্ত্বিকতায় ব্যাংকের ব্যর্থতা সরকারের ব্যর্থতায় গিয়ে আঘাত করে। রেগুলেশনের ব্যর্থতা আরো বেশি রেগুলেশন নিয়ে আসে। আসলে মার্কেট ব্যর্থতা আর সরকারের ওপর এ বিষয়ের প্রভাব আরো বেশি সরকারের হস্তক্ষেপ সৃষ্টি করে। তাই বিজনেস সিস্টেমটাকে এগিয়ে যাওয়ায় সরকার তখন স্বাধীনতা কম দেবেÑ এটাই স্বাভাবিক।

বিশ্বব্যাংকের ভারত কার্যালয়ের প্রধান বা কান্ট্রি ডিরেক্টর জুনায়েদ কামাল আহমাদ বলেছেন, সংসদ সদস্যরা ব্যাংক খাতে জড়িয়ে পড়েছেন এবং ব্যাংক খাতের নৈতিকতাকে উপেক্ষা করছেন। এ জন্য আর্থিক খাতের নৈতিকতার সঙ্গে রাজনীতিবিদদের নৈতিকতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এ জন্য তিনি বলেন, যদি একটি নৈতিকতাসম্পন্ন সংসদ তৈরি করা যায়, তা হলে ব্যাংক খাতেও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে। এক তাত্ত্বিকের রেফারেন্সে তিনি একাংশে উদাহরণ দেন ‘এরাব সব a Ethical Parliamentarz Szstem, ও will give zou a Ethical Banking SzstemÕ’। ব্যাংকিং সিস্টেমে Ethics বুঝতে হলে পলিটিক্যাল রিলেশনশিপটা বুঝতে হবে। যেটা পলিটিকস, পলিটিক্যাল ইকোনমি আর পাবলিক পলিসির সমন্বয়ের ‘Imperfection of Political Szstem’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতার চর্চা জোরদার করতে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালী হওয়া জরুরি, যা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে টেকসই করতে পারবে এবং ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা বাড়াতেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে সুশীল সমাজের বিশেষ ভূমিকার ওপর জোরারোপ করে তিনি বলেন, আর্থিক ব্যবস্থায় সোচ্চার শক্তি (অ্যাডিশনাল ভয়েস) হিসেবে সুশীল সমাজকে কাজ করতে হবে। সুশীল সমাজের নজরদারি ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চেক অ্যান্ড ব্যালান্স স্থাপনে সহায়ক হবে। নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে সুশীল সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে বলে মত দিয়েছেন তিনি।

প্রাসঙ্গিক যে, এ বিষয়টি সরকার আর বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক গুরুত্ব দিচ্ছে বর্তমানে। সব ব্যাংকের একসঙ্গে আওয়াজ তোলা উচিত একটা বেঞ্চ মার্কে এসে খেলাপি বা নন পারফর্মিং লোন হ্রাস করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। তিনি বলেন, জনগণের জানতে চাওয়ার অধিকার চর্চা থাকা প্রয়োজনÑ তাদের টাকার কী হচ্ছে?

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, স্বল্প সময়ে আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করায় কিছু সমস্যা হয়েছে। এজন্য বন্ড বাজারকে উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকারদের উদ্দেশে গভর্নর বলেন, ব্যাংকের চাকরি বিশ্বাস রক্ষার, এটা মুনাফা করার ব্যবসা না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারির সক্ষমতা নিয়মিত বাড়ানো হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থা নজরদারিতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি আলাদা বিভাগ কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সহযোগিতায় ব্যাংকিং খাত যাতে আইনকানুনের মধ্য থেকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালিত হয়, তা সার্বক্ষণিক তদারক করছে। তিনি বলেন, কিছু অনিয়মের কারণে অর্জনগুলো মলিন হয়ে যায়। তবে ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের কারণেই শুধু নয়, কিছু ঋণগ্রহণকারীর উচ্চাকাক্সক্ষাও ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি তৈরি করছে। স্বল্পসংখ্যক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে অনিয়মকারীদের যোগসাজশ এবং প্রভাবশালী খেলাপির কারণে পুরো অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

গভর্নর ফজলে কবিরের বক্তব্যের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আমরাও বলতে চাই, অনৈতিক চর্চাগুলো দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আজকের মেমোরিয়াল লেকচারের মাধ্যমে তরুণ ব্যাংকাররা সততা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবেন এবং ব্যাংকিং খাত আরো পেশাদারিত্বের দিকে অগ্রসর হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : অর্থনীতিবিদ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close