জি. কে. সাদিক

  ১২ মার্চ, ২০১৯

আন্তর্জাতিক

ভেনিজুয়েলা সংকটের সম্ভাব্য গতিবিধি

এ বছরের শুরুতে লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গন আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিশ্ব-মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভেনিজুয়েলাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাময় বিভক্তি ঘটেছে। দুই পক্ষের অবস্থান দুই মেরুতে। এমতাবস্থায় ভেনিজুয়েলার চলমান সংকট নিয়ে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে কথা উঠছে ভেনিজুয়েলায় মাদুরোর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে। এর সঙ্গে অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে, ভেনিজুয়েলার সংকট নিরসনে যদি সামরিক শক্তি প্রয়োগ ঘটে; তখন পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে? তা বিবেচনায় বেশ কিছু বিষয় সামনে আসে। তাই আগে দেখা প্রয়োজন, ভেনিজুয়েলা সংকটের মূলে কোন বিষয়গুলো রয়েছে এবং এটা সংকটকে কোন খাতে প্রবাহিত করতে পারে।

প্রথমেই আলোচনায় আসে ভেনিজুয়েলার রাজনৈতিক অবস্থার কথা। এটা স্পষ্ট, দেশটিতে এখন গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও নাগরিক অধিকার চরমভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। তবে শুধু এটুকু বলেই শেষ করা যাবে না। রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গিভূত হয়ে আছে অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ। এ দুটি বিষয়ে মার খাওয়ার ফলে ভেনিজুয়েলাতে পুরোনো সংকট ক্রমে দানা বেঁধে এ পর্যায়ে এসেছে। মাদুরোর পূর্বসূরি ভেনিজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ ছিলেন বাম ঘরানার এবং রাজনীতিতে ছিলেন সাইমন ভলিবারের ভাবশিষ্য। সাইমন ভলিবারের মতো তিনিও স্বপ্ন দেখতেন লাতিন আমেরিকাকেন্দ্রিক ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের। সেজন্য প্রাথমিক উদ্যোগে তিনি স্বপক্ষে জনমত গঠনের জন্য ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ব্যাপক হারে বই ছাপানো ও পঠনের কার্যক্রম হাতে নেন। কিন্তু এ কাজে তার সফলতা আসেনি। অর্থনৈতিকভাবে অনেক আগে থেকেই ভেনিজুয়েলা তেল রফতানিনির্ভর রাষ্ট্র। শ্যাভেজ নিজেও দেশীয় শিল্পের প্রতি ও উৎপাদনের প্রতি জোর না দিয়ে ভেনিজুয়েলাকে একটি তেলনির্ভর রাষ্ট্র করেই রাখেন। যদিও তিনি রাষ্ট্রের নিম্নবিত্তের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতি বেশি জোর দিয়েছেন তথাপি তার এ কাজ বৃহদকারের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়। বিশ্লেষকরা এটাকে শ্যাভেজের রাজনৈতিক-অর্থনীতির প্রজ্ঞার অভাব বলে থাকেন।

হুগো শ্যাভেজ মারা যান ২০১৩ সালে। মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন তার শিষ্য বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। তিনি ছিলেন শ্যাভেজের ভাইস প্রেসিডেন্ট। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিক থেকে মাদুরো শ্যাভেজের চাইতে অনেক অপরিপক্ব, অন্যদিকে তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অর্থনৈতিক অনটন আরো প্রকট হতে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার ফলে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতিতে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থ-সংকট বাড়তে থাকে। অন্যদিকে আমদানিনির্ভরতা আরো বাড়ে। এটা দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক ধসের সৃষ্টি করে। এদিকে জনগণের মধ্যে সেনানির্ভর শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তির দাবি আরো জোরালো হতে থাকে। তাই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মাদুরো নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে নেন এবং ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর ওপর নির্যাতন ও নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে আবার ক্ষমতায় আসেন। নির্বাচনে বড় ধরনের কারচুপি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ আরো উসকে দেয়। মাদুরোর আমলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বাজার ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতার ফলে বাড়তে থাকে মুদ্রাস্ফীতি। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে জীবিকার তাগিদে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। রাজনৈতিক অধিকার হরণ, বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন, মন্দা অর্থনীতি ও নির্বাচনে কারচুপির ফলে দেশটির অভ্যন্তরে ব্যাপক গণ-অসন্তোষ দেখা দেয়; যা ক্রমে ক্ষুব্ধ জনতাকে রাস্তায় নামিয়ে আনে। জনতার এ বিক্ষোভের মাত্রার ওপর নির্ভর করতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মাদুরো কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। সম্প্রতি আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট জোয়ার গুইদো ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করে স্বীয় পক্ষে আঞ্চলিক রাজনীতিতে শক্ত ভিত্তি করে তুলছেন বলে মনে হচ্ছে এবং তিনি দেশে ফেরার কথা ঘোষণা দিয়ে গ্রেফতার এড়াতে জনগণকে আবার রাস্তায় নেমে আসার ডাক দিয়েছেন। এর সাড়াও মিলেছে। তাই দেশটির রাজনৈতিক সংকটের জটিলতা কমার সম্ভাবনা কম দেখা যাচ্ছে।

মাদুরো রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে সমাজতন্ত্রী। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে তিনি জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস তেল সম্পদকে জাতীয়করণের দিকে এগোতে থাকে। যেটা আন্তর্জাতিক তেল বাণিজ্যকারী করপোরেটদের স্বার্থে বড় ধরনের আঘাত। ১৯২২ সাল থেকে আমেরিকান ও ডাচ তেল উত্তোলনকারী কোম্পনিগুলোর মাধ্যমে ভেনিজুয়েলাতে তেল ও পেট্রোলিয়াম তোলা হয়। ভেনিজুয়েলার শাসকশ্রেণি কখনো তেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিজেদের সক্ষমতার কথা ভাবেনি। আর তেল রফতানির ক্ষেত্রে ভেনিজুয়েলার বড় ক্রেতা দেশ আমেরিকা। যার ফলে দেশটির অর্থনীতির প্রধান চাবি আমেরিকার হাতে জিম্মি রাখে। মাদুরোকে আমেরিকা পছন্দ করে না এবং তেল খনিগুলোকে জাতীয়করণ নীতি গ্রহণের ফলে এ অপছন্দের মাত্রা আরো বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ভেনিজুয়েলার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের জন্য আমেরিকাকে একটা বড় সুযোগ করে দেয়। মাদুরো যখন গত ১০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই দেশটিতে বিরোধী দল কর্তৃৃক সৃষ্ট ব্যাপক গণ-আন্দোলন দেখা দেয়। মওকা বুঝে বিরোধীদলীয় নেতা জোয়ান গুইদো নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে জয়লাভকারী মাদুরোকে অবৈধ প্রেসিডেন্ট দাবি করে নিজেকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন। এটা আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য একটা সুযোগ করে দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ৫০টি দেশ জোয়ান গুইদোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র বলিভিয়া বাদে দক্ষিণ আমেরিকার বাকি দেশগুলো মাদুরো প্রশাসনের বিপক্ষে। তারাও গুইদোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাদুরোবিরোধী একটা বড় জোট গঠন হয়েছে। তেলনির্ভর ভেনিজুয়েলার প্রধান ক্রেতা আমেরিকা ইতোমধ্যে দেশটির তেল বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যার ফলে দেশটির অর্থনীতির চাকা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়। তাই ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে মাদুরোকে অবশ্যই অর্থনৈতিক ধস ঠেকাতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির পুনরায় গঠন করতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাত্রা যদি এভাবে চলতে থাকে বা আরো বাড়ে; তাহলে সেটা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে কিছু দেশ বাদে সহযোগিতার হাতও বেশি প্রসারিত হবে না। তাই প্রশ্ন ওঠেÑ এমন ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থান নিয়ে মাদুরো কি টিকতে পারবেন?

মাদুরোর পক্ষে আন্তর্জাতিক শক্তি হচ্ছেÑ সাবেক সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, কিউবা, ইরান ও মেক্সিকো। কিন্তু ভূ-রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বাজারের ক্ষেত্রে অক্ষশক্তির চাইতে মিত্রশক্তির অবস্থান তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। কারণ ভেনিজুয়েলার প্রতিবেশী দেশ ব্রাজিল, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, চিলি মাদুরোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে ৩০ লাখ শরণার্থী বোঝা তাদের এ অবস্থানে যেতে বাধ্য করেছে। প্রতিবেশীদের এমন অবস্থান মিত্রশক্তির দেশগুলোর জন্য মাদুরোর বিপক্ষে বল জোগাবে। ভেনিজুয়েলার অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, ইরান ও কিউবা তুলনামূলক আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর চাইতে পিছিয়ে আছে। তাই যদি আমেরিকার তেল বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরো বেশি স্থায়ী হয়; তাহলে সেটা ভেনিজুয়েলার বর্তমান পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলবে, যা মাদুরোর জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, যদি আমেরিকা ও তার মিত্রদেশগুলো বর্তমান সরকার উৎখাতের জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ করে; তাহলে অক্ষশক্তির পক্ষে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। কারণ ভৌগোলিকভাবে রাশিয়া থেকে ভেনিজুয়েলা অনেকদূরে। সামরিক দিক থেকে ভেনিজুয়েলার পাশে দাঁড়াতে হলে তাকে কৃষ্ণসাগর ও বাল্টিক সাগর থেকে রণতরী পাঠিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে হবে। যদি আকাশপথ দিয়ে ভেনিজুয়েলার সাহায্যে সৈন্য পাঠাতে চায়; তাহলে তাকে নিতে হবে কলম্বিয়ার আকাশপথের সাহায্য; যা হয় তো কলম্বিয়া দেবে না। আর চীন যদি যুদ্ধ অংশ নিতে চায় তাহলে তাকেও প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিতে হবে। যার জন্য প্রয়োজনীয় নৌশক্তি চীনের অনেকটাই অপ্রতুল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর আকাশপথের ক্ষেত্রে রাশিয়ার মতো চীনের জন্যও কলম্বিয়া বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই বলা যাচ্ছে না, সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যদি মাদুরোকে উৎখাত করতে চায়; তাহলে মাদুরোর স্বীয় মিত্রপক্ষের যথেষ্ট সাহায্য পাবে।

অনেক বিশ্লেষকই ভেনিজুয়েলা সংকটকে সিরিয়ার সংকটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন। কিন্তু এটা অনেক ক্ষেত্রেই মিলছে না। ভৌগোলিক দূরত্ব, সেনাবাহিনীর অবস্থান, রাজনৈতিক বিভক্তি ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এসব বিষয়ে সিরিয়ার সঙ্গে মেলানো যায় না। সংকটের সময় সিরিয়ার পাশে শুরু থেকেই রাশিয়া ও ইরান ব্যাপক সমর্থন ও সহায়তা নিয়ে দাঁড়ায়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে রাশিয়া ও ইরানের উপস্থিতি ও সহায়তা সিরিয়াতে বাশার আল-আসাদকে টিকে যেতে সহায়তা দেয় এবং সেনাবাহিনীর একটা অংশের শক্তিশালী সমর্থন তো ছিলই। তা ছাড়া সিরিয়াকে ভেনিজুয়েলার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিভক্তি ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে হয়নি। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তার ক্ষেত্রও ছিল প্রশস্ত। অন্যদিকে, ভেনিজুয়েলা শুরু থেকেই রাজনৈতিকভাবে বিভক্তির শিকার, মন্দা অর্থনীতি ও তেল বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা, প্রতিবেশী দেশগুলোর বৈরী মনোভাব ইত্যাকার বিষয়ে সিরিয়ার চাইতে ভেনিজুয়েলা অনেকটা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন।

ভেনিজুয়েলার এতদ পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভেনিজুয়েলার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নেবে, তা বলা কঠিন। কারণ, বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর কাছে দেশের জনগণ প্রাধান্য পাবে না কি, ক্ষমতাই শেষ কথা সেটার ওপর নির্ভর করছে ভেনিজুয়েলার পরবর্তী পরিস্থিতি কী হবে। তবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের পরিস্থিতি বিবেচনায় জোয়ান গুইদোর তুলনায় মাদুরো অনেকটা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আর সহজে ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ মাদুরোর জন্যই হয়তো দেশটির সার্বিক পরিস্থিতি আরো নাজুক হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close