আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৮

পর্যবেক্ষণ

পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল

গর্ব করার মতো বেশ কিছু বিষয় আছে আমাদের। কিন্তু গর্ব করার কেন্দ্রে আছে স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন। বিজয় অর্জনের সাক্ষী হিসেবে আমাদের আছে অতি গর্ব করার মতো একটা বিষয়। চূড়ান্ত বিজয়কে কেন্দ্র করেই আমাদের আশা ও আকাক্সক্ষাগুলো আবর্তিত হয়। কেননা, চূড়ান্ত বিজয় না হলে দেশ পেতাম না আমরা। পর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো। আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করা যেত না। যেমন পারিনি পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলে।

বিশ্বের স্বাধীনতাকামীদের জন্য যা বিরল। আমাদের বিজয় দিনে এমন একটি গর্বের বিষয় রয়েছে। কিন্তু তা কম আলোচিত হয়। কম আলোচিত একটি বিষয় আমি আলোচনা করব আজ। হার স্বীকার করে প্রকাশ্যে শত্রুপক্ষের সমর্পণ এবং সে দেশের বাহিনী/যোদ্ধাদের কাছে প্রকাশ্যে মালিকানা ত্যাগ করার ইতিহাস বিশ্বে বিরল। আর সেটাই হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে, রেসকোর্স ময়দানে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে পাকিস্তানিদের পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের পর থেকে বাংলার মাটিতে শুরু হয় ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ। মাতৃভূমিকে রক্ষা ও শত্রুমুক্ত করার এই সংগ্রামে আমরা হারিয়েছি প্রায় ৩০ লাখ স্বজন। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার পর এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বিজয় আমাদের হাতে ধরা দিয়েছিল। কোণঠাসা পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররা এই বাংলার মাটিতেই আত্মসমর্পণ করে মাথা নিচু করে পরাজয় মেনে নেয়। ১৯৭১ সালের এই ১৬ ডিসেম্বরে পৃথিবীর মানচিত্রে পাকাপাকি স্থান করে নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম নতুন একটি দেশ, বাংলাদেশ। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি আমরা।

এ কথা আমরা সবাই জানি এবং সব সময় আলোচনা করে থাকি। এ কথা অনেক আলোচিত হয়। ১৪ ডিসেম্বর বহু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে পাকিস্তানি হায়েনা ও দেশীয় দোসররা। ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রাদেশিক সরকারের বেসামরিক উপদেষ্টা মেজর রাও ফরমান তাদের দোসরদের সঙ্গে সদর দফতরে রাতে এক গোপন বৈঠক করে। সেখানে তৈরি করা হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা। সেই নীলনকশা অনুযায়ী হত্যা করা হয় জাতির মেধাবী সন্তানদের। বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকদের ১৪ ডিসেম্বরে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। এটা ছিল পরিকল্পিত। পরাজয় নিশ্চিত ভেবে পাকিস্তানি হায়েনাদের এ বর্বর কর্মকা- বিশ্বকে বেশি করে জানাতে হবে। এ কথা এখন অনেক আলোচনা হলেও আগে কম আলোচিত হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে একটা জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা আমাদের আরো আলোচনা করতে হবে। বাস্তব অভিজ্ঞতাসমপন্ন মুক্তিযোদ্ধারা আলোচনা বেশি করলে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে প্রকৃত ইতিহাস। বিজয় দিবসে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক কর্মকর্তা জন কেলি সকাল বেলায় ঢাকায় আসেন। সেনানিবাসের কমান্ডো বাংকারে লে. জেনারেল নিয়াজীকে পাওয়া না গেলেও বিধ্বস্ত অবস্থায় পাওয়া যায় জেনারেল রাও ফরমানকে। রাও ফরমান জন কেলিকে বলেন, তারা মিত্রবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে এবং তারা আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু মিত্রবাহিনীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় এ বিষয়টি তাদের জানাতে পারছে না। এ সময় জন কেলি রাও ফরমানকে জাতিসংঘের বেতার সংকেত ব্যবহারের কথা বলেন। তখন আত্মসমর্পণের জন্য সময় নির্ধারণ করা হয় বিকেল সাড়ে ৪টা। সকাল ১০:৪০ মিনিটে ঢাকায় প্রবেশ করে মিত্রবাহিনী। বিকেল সাড়ে ৪টায় লে. জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে ৯১ হাজার ৫৪৯ জন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেনা। মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণের দলিলে বিকেলে সই করেন লে. জেনারেল নিয়াজী ও লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। সেখানে মুজিবনগর সরকার থেকে সেখানে উপস্থিত ছিলেন ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। কিন্তু আত্মসমর্পণ দলিলে পরাজিত বাহিনীর সম্মুখে লিখিতভাবে মেনে নিয়ে মালিকানা ত্যাগ বা হস্তান্তর করার বিষয়টি আমাদের জন্য গর্বের। পাকিস্তানি বাহিনীর ঘোষণা ছিল এরূপÑ ‘পূর্ব পাকিস্তানে কর্তব্যরত সব পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথবাহিনীর কমান্ডিং চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের সম্মতি প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশের যে যে স্থানে পাকিস্তানি ভূমি, বায়ু এবং নৌবাহিনী রয়েছে, তাদের অবিলম্বে নিকটস্থ কমান্ডিং চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কমান্ডের অধীনে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এই নির্দেশ অমান্য করা হলে যুদ্ধের রীতিনীতি অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে এবং কমান্ডিং চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নির্দেশ চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়া হবে। কমান্ডিং চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা জেনেভা কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী আত্মসমর্পণকারী সব পাকিস্তানি সেনাকে পূর্ণ মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে নিরাপত্তা দেওয়া নিশ্চিত করছেন।’

এরপর একে একে সব পাকিস্তানি সেনা পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট এ কে নিয়াজীর নেতৃত্বে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। যৌথবাহিনীর পক্ষে জগজিৎ সিং অরোরা। আরো উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে পাকিস্তান নৌবাহিনীর ভাইস এডমিরাল মো. শরীফ, তাদের বিমানবাহিনীর ভাইস মার্শাল প্যাট্রিকসহ সব বাহিনীর কর্মকর্তারা। তাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সব থেকে বৃহত্তম সংখ্যার যুদ্ধবন্দি বলা হয় এই পাকিস্তানি সেনাদের, যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ঘটনা। রমনা রেসকোর্সের এ দলিলকেই বলা হয় The Pakistani Instrument of Surrender বা পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল। এ দলিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এটা গর্ব করার মতো বিষয় আমাদের জন্য। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

এটা একদিক দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য। বেশ কয়েকটা পাবলিক সারেন্ডার বিশ্বে থাকলেও বৈশিষ্ট্যম-িত আমাদেরটি। মাত্রা চার ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব, যা আত্মসমর্পণের হিসাবে রূপান্তরিত হয় এবং শত্রুপক্ষ বাংলাদেশের মাটি, বায়ু অন্যান্য সম্পদ ঘোষণা করে মালিকানা হস্তান্তর করে। এভাবে আত্মসমর্পণের দৃশ্য বিশ্বে দুর্লভ। এটা প্রতিরক্ষা বাহিনীর চূড়ান্ত অবমাননাকর, যা তাদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার চেয়েও গর্হিত কাজ। আমাদের বীর বাঙালি সেটাই করে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমিও গর্ববোধ করি এ বিষয় নিয়ে, স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে কিংবা বিজয় নিয়ে। বীর বাঙালি ও মা- বোনের ইজ্জত ও বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে পাওয়া চূড়ান্ত এ বিজয়ে আমরা দেশ নিয়ে চিন্তা করি। দেশের জন্য কিছু করি। তাহলে শহীদদের আত্মা শান্তি পেতে পারে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close