রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১১ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার কাতালোনিয়া

কাতালোনিয়া হলো গোটা ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ করদাতা অঞ্চল। অথচ এখানকার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে বা আধুনিকায়নে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার কোনো অর্থ ব্যয় করে না বলে কাতালান জনগণের অভিযোগ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক সিদ্ধান্তই কাতালোনিয়ার অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে বলেও অভিযোগ করা হয়। এসব কিছু মিলে কাতালানরা স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেÑএমনটা কাতালানদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ। এ বঞ্চনাবোধই কাতালান জনগণের মধ্যে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা জাগ্রত করেছে কাতালানদের স্বাধীনতার এ চেতনা ও দাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে এবং সেটি একসময় স্বাধীন কাতালোনিয়া প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে দেবেÑএমনটাই রাজনীতি বিশ্লেষকদের অভিমত। কাতালান একটি জাতি এবং তাদের রয়েছে হাজার বছরেরও অধিক সময়ের ঐতিহ্য এ চেতনায় সমৃদ্ধ কাতালানরা তাই মাঝেমধ্যেই স্পেন থেকে বের হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছে এবং সেটি আবার ভেস্তেও গেছে। কাতালানরা পরিসংখ্যান দিয়ে বলছে ২০১৭ সালে স্পেনের মোট জিডিপির ৮ শতাংশই কাতালোনিয়া থেকে এসেছিল। আর ওই সময় ওখান থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে কর দেওয়া হয়েছিল ষোলো কোটি ইউরো। অথচ করের অর্থ থেকে কাতালানদের জন্য ব্যয় করা হয়নি কানাকড়িও। ১২৩৯৭ বর্গমাইল আয়তনের ৭.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত কাতালোনিয়ার রাজধানী হলো বার্সেলোনা, যে শহরটি বিশ্বব্যাপী পরিচিত।

স্পেনের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৬ শতাংশের আবাসভূমি হলো এই কাতালোনিয়া। সম্পদে এবং প্রাচুর্যে ভরপুর কাতালোনিয়া হলো স্পেনের সবচেয়ে শিল্পোন্নত এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল। আর রাজধানী বার্সেলোনা হলো বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন শহর। কাতালানরা মনে করেন, শুধু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভাষা, প্রথা বা সাংস্কৃতিক দিক থেকেই নয়, বরং জীবনধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাতালানদের রয়েছে স্বতন্ত্র নিজস্ব পরিচিতি ও স্বাতন্ত্র্যবোধ। তাই তাদের নিজস্ব একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার রয়েছে। এটি তাদের মানবিক অধিকার বলেও তারা দাবি করছে। কাতালোনিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সাবেক প্রেসিডেন্ট, কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল নেতা এবং বর্তমানে স্বদেশ থেকে নির্বাসিত কার্লোস পুজেমন ও কাতালানদের সঙ্গে একই সুরে বলেন কাতালোনিয়া হ্যাড এ মরাল, কালচারাল, ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইট টু সেলফ ডিটারমিনেশন। কাতালানরা ঐতিহ্যগতভাবেই স্বাধীনচেতা এবং একসময় কাতালোনিয়া একটি স্বাধীন সা¤্রাজ্য ছিল। কাতালানরা দাবি করেন, তাদের রয়েছে হাজার বছরের নিজস্ব ঐতিহ্যম-িত ইতিহাস এবং পৃথক জাতিসত্তা। অর্থাৎ কাতালান জনগণ নিজেদের পৃথক জাতি হিসেবেই দাবি করে থাকে। ইতিহাস পর্যালোচনা

করে দেখা যায়, কাতালানদের নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি, ভাষা ও প্রথা প্রকৃত অর্থেই হাজার বছরের পুরনো। স্পেনের

অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এসবের কোনো পরিবর্তন হয়নি, কাতালান জনগণ তাদের অতীত ঐতিহ্য ধরে রেখেছে তাদের জীবনযাত্রায়।

অন্য যেসব কারণ কাতালানদের স্বাধীনতায় অনুপ্রাণিত করেছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ঐতিহাসিক লিগেসি, ভৌগোলিক অবস্থান, ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এর সাথে রয়েছে রাজনৈতিক কারণ। ইতিহাস থেকে আরো দেখা যায়, কাতালানরা স্বাভাবিকভাবেই এবং অভ্যাসগতভাবে স্বাধীনতার মূল্যবোধ সম্পন্ন এবং মধ্যযুগের প্রথমার্ধে কাতালান মানুষরা নিজেদের স্পেন থেকে স্বতন্ত্র একটি জাতি হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিল। আর একাদশ শতকের দিকে বার্সেলোনা রাষ্ট্রের উদ্ভবের মধ্য দিয়ে কাতালানদের স্বতন্ত্র পরিচিতি, ঐতিহ্য এবং স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্পষ্ট হয়েছিল। তবে দ্বাদশ শতকের দিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র মধ্যযুগের বৃহৎ নৌশক্তি সম্পন্ন সা¤্রাজ্য অ্যারাগনের কাছে বার্সেলোনার পতন হলে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার অবসান ঘটে এবং এটি অ্যারাগনের অংশে পরিণত হয়। ১৪৬৯ সালে অ্যারাগানের রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং কাস্টিলের রানি ইসাবেলা বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কাতালোনিয়া অঞ্চল স্পেনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সেই থেকে কাতালোনিয়া স্পেনের একটি অংশ হয়ে আছে। তবে ইতিহাস প্রমাণ করে যে, এর পূর্বে ২৫০ বছর কাতালোনিয়া একটি স্বাধীন সা¤্রাজ্য ছিল। কাতালোনিয়া স্পেনের অংশ হলেও কাতালানদের পৃথক সত্তার ওপর আঘাত আসেনি স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কো রাষ্ট্র ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত। ১৯৩৬-১৯৩৯ সময়কালে স্পেনের গৃহযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো স্পেনের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তার দীর্ঘ চল্লিশ বছরের শাসনামলে কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে এবং ওখানটায় স্পেনের কেন্দ্রীয় শাসন চাপিয়ে দেওয়া হয়।

কাতালানদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও ঐতিহ্য এবং জাতীয়তাবোধ ধ্বংস করার জন্য ফ্রাঙ্কো কাতালান ভাষার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কাতালান সংস্কৃতি ও প্রথা মুছে ফেলার জন্য কাতালান সন্তান-সন্ততিদের নামকরণ কাতালান ভাষার পরিবর্তে স্প্যানিশ ভাষায় নামকরণের আদেশ জারি করা হয়। উল্লেখ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাতালান ভাষার স্থান চৌদ্দতম এবং কাতালান একটি সমৃদ্ধ ভাষা এবং প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন মানুষ কাতালান ভাষায় কথা বলে। অথচ এই ভাষার বিলুপ্তি সাধনের জন্য ফ্রাঙ্কো কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন, যা কাতালানদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত করেছিল। নানা উত্থান, পতন, অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার কাতালান জনগণের মধ্যে ক্রমেই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মনোভাব শানিত করে। শিল্প, ব্যবসা এবং পর্যটন হচ্ছে কাতালোনিয়ার অর্থনীতির মূল ভিত্তি। স্পেনের মোট জিডিপির ২০ শতাংশই আসে কাতালোনিয়া থেকে। স্পেনের প্রধান

বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং পর্যটন কেন্দ্র

কাতালোনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত বলে স্পেনের অর্থনীতির নিয়ামক ও চালক হলো কাতালোনিয়া, যে কারণে এ অঞ্চলকে বলা

হয়ে থাকে স্পেনের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। গোটা স্পেনের অর্থনীতির পাওয়ার হাউস হিসেবে গণ্য করা হয়

কাতালোনিয়া অঞ্চলকে। অথচ কাতালানরা তাদের ন্যায্য অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করে কাতালানরা। কাতালানরা বিশ্বাস করে স্পেনের জাতীয় অর্থনীতিতে কাতালোনিয়া, যা দিচ্ছে তার সামান্য অংশ মাত্র কাতালান জনগণের উন্নয়নে ব্যয় করা হচ্ছে। অর্থনীতির সিংহভাগই ব্যয় করা হচ্ছে মাদ্রিদের জন্য।

উল্লেখ্য, ইউরোপের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের কোনো কোনো অঞ্চল মূল রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে এবং এ জন্য মাঝেমধ্যেই বিক্ষোভ, গণ-আন্দোলন এবং এমনকি স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট পর্যন্ত হতে দেখা গেছে। ইউরোপের ১০টি রাষ্ট্রের ১০টি অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীরব ও সরব আন্দোলন বিদ্যমান রয়েছে। স্বাধীনতার জন্য জাগ্রত চেতনা কত দিন দাবিয়ে রাখা যাবে, সেটি বলা বড় প্রশ্ন বটে। তবে বিশ্লেষকদের ধারণা স্বাধীনতা যদি দাবিয়ে রাখা সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ দিনগুলোতে ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের মধ্যেও সংকট দেখা দিতে পারে এবং এ জন্য হয়তো

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে যেতে পারে। ইউরোপে

স্বাধীনতার জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে

দীর্ঘ মেয়াদে আন্দোলন করে আসছে স্পেনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কাতালোনিয়া। কাতালানরা কেন স্পেন থেকে

বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে, কেন স্বাধীন কাতালোনিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে বিশ্লেষকদের মধ্যে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা অবশ্য এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাদের অভিমত অন্য কারণগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক কারণ হলো গুরুত্বপূর্ণ। মূল স্পেন দ্বারা কাতালানরা যুগ যুগ ধরে শোষিত হচ্ছে বলে কাতালানবাসী জনগণের অভিযোগ। ফলে তারা স্বাধীনতায়ই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে বিধায় স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছেÑএমনটাই রাজনীতি বিশ্লেষকদের অভিমত।

লেখক : বিশ্লেষক, গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close