এস এম আরিফুল কাদের

  ২৮ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

শিশুর জন্য আদর্শ শিক্ষা

মানবসমাজের ভিত্তি হলো পরিবার। স্বামী-স্ত্রীকে কেন্দ্র করে যা শুরু হয়। আদম ও হাওয়া (আ.)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রথম মানব পরিবার গড়ে ওঠে। সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে আজও এ পরিবার প্রথা চালু আছে। সারা দিনের কর্মক্লান্তি, বিভিন্ন কারণে মানব মনে পাওয়া দুঃখ-বেদনায় যেখানে সবাই শান্তি খোঁজে সেটা হলো পরিবার। যদি পরিবারে শান্তি-শৃঙ্খলা থাকে তাহলে মানবজীবন সুখময় হয়। পক্ষান্তরে পরিবারে কাক্সিক্ষত শান্তি না থাকলে জীবন হয়ে ওঠে বিতৃষ্ণ, বিষাদময়। এজন্য দরকার একটি আদর্শ পরিবার। আর আদর্শ পরিবারের জন্য প্রয়োজন আদর্শ দাম্পত্য। পাশাপাশি উপযুক্ত শিক্ষায় শিশুকে গড়া যায় আদর্শ রূপে। যার ফলে পরিবার হবে মানুষের আরাম-আয়েশ ও সুখ-শান্তির আকর।

পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে (জাহান্নামের) অগ্নি থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা তাহরিম : ৬)। উক্ত আয়াতে কারিমা থেকে নিজেকে বাঁচানোর পাশাপাশি পরিবার-পরিজন অর্থাৎ শিশুকে আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা চাই। মানবশিশুর সবচেয়ে কার্যকর এ বিদ্যাপীঠে শিশুকে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন করে গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম।

পরিবার একটি পবিত্র সংস্থা। মানবশিশুর সর্বপ্রথম ও সর্বোত্তম শিক্ষালয়। মা-বাবাই সন্তানের প্রথম আদর্শ শিক্ষক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ যুগেও যেমন নবজাতকের জন্য মায়ের দুধের বিকল্প খাবার কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি; তেমনি সুনাগরিক তৈরিতে পরিবারের বিকল্প কোনো প্রতিষ্ঠান আজও গড়ে ওঠেনি। তাই ইসলাম পারিবারিক পরিবেশে দ্বীনচর্চার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু আধুনিকতার নামে সেই পারিবারিক শিক্ষায় যেমন উপেক্ষিত বাংলা ভাষা; তেমনি উপেক্ষিত ইসলামও। মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই একসঙ্গে দেখছে হিন্দি ফিল্ম। শিশু শিক্ষা নিচ্ছে ছুরি দিয়ে অন্যকে হত্যা করার বিদ্যা। ফজরের নামাজে বাবার হাত ধরে জামাতে শামিল হওয়ার দৃশ্য হারিয়ে গেছে কথিত আধুনিকতার অতলগহ্বরে। বাড়ছে জিপিএ-৫সহ পাসের হার, কমছে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা। ফলে পারলৌকিক জীবনের শাস্তি তো আছেই; পার্থিব জীবনেও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে দুঃসহ যন্ত্রণা।

আজকের শিশু আগামী জাতির কর্ণধার। তাকে আদর্শবান হয়ে গড়ে তোলার মহান দায়িত্ব পালনে পরিবারের সদস্যদের আজই সতর্ক হতে হবে। দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে মা-বাবাকে। কেননা হাদিসে নববিতে এসেছে, ‘প্রত্যেক সন্তানই ফিতরাতের (ইসলাম) ওপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি বা খ্রিস্টান কিংবা অগ্নিপূজক বানায়’ (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, মিশকাত)। তাই পরিবারেই দ্বীন শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। আকাশ, চন্দ্র-সূর্য, বৃষ্টিতে যে মহান শক্তির হাত, তা শুনিয়ে সুকৌশলে তিলে তিলে তার কোমল হৃদয়ে আল্লাহ তায়ালার প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ভীতির বীজ বপন করা একান্ত প্রয়োজন। শিশুরা গল্প শুনতে ভালোবাসে। আজগুবি গল্প না বলে সাহাবায়ে কেরাম, ইসলামী মনীষীদের হৃদয়কাড়া গল্প শুনিয়ে ইসলামের প্রতি গভীর ভালোবাসা বদ্ধমূল করে দিতে হবে। শোনাতে হবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাত। অনেক সময় আমরা শিশুদের ভোলাতে, থামাতে কিংবা শান্ত করতে বলে থাকি ‘এ কিনে দেব, ও কিনে দেব’। কিন্তু বাস্তবে তা আদৌ করি না। সেটা যে ওয়াদা পূরণের ইচ্ছা নেই, তা করা মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত। এতে শিশুর মস্তিষ্কে প্রতারণার চিত্র ধারণ করবে। সহজেই শিখে নেবে প্রতারণা।

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা শেখাতে হবে পরিবারেই। বড়কে শ্রদ্ধা, ছোটকে স্নেহ করার মানসিকতা তৈরি করে দিতে হবে পরিবারেই। যে মানুষ যত বড়, সে তত বিনয়ী। শিক্ষা দিতে হবে বিনয়-ন¤্রতার মহান গুণ। প্রতিবেশী গরিব-দুঃখীদের সঙ্গে মিশতে দিতে হবে। সন্তান যতই ছোট হোক, এমনকি দুধের শিশু হলেও তার সামনে কোনো ধরনের যৌনালাপ ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এতে তার মস্তিষ্কে নির্লজ্জের যে ছাপ পড়বে, তাতে শয়তানের কুমন্ত্রণায় তা প্রকট হয়ে উঠবে।

সামান্য অন্যায়ে বকাঝকা করা অনুচিত। প্রয়োজনে একান্তে বসে শাসন করা যায়। ইসলামী অনুশাসনের প্রতি তাকে আগ্রহী করার শ্রেষ্ঠ সময় এখনই। অশীলতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পরিবারে পর্দার বিধান কঠোরভাবে মেনে সন্তানকে এর প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে হবে। মা-বাবাকেই প্রথম সময়মতো নামাজ আদায়ের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। সন্তানকেও শেখাতে হবে নামাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) সন্তানকে শৈশবেই নামাজের আদেশ করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের সন্তানের বয়স যখন সাত বছর হয়, তখনই তাদের নামাজের আদেশ দাও।’ (আবু দাউদ)।

প্রাইভেট শিক্ষক রেখে কিংবা মক্তবে পাঠিয়ে যেভাবেই হোক সন্তানকে পরিবার থেকেই কোরআনি শিক্ষা দিতে হবে। ‘আধুনিকতার নামে সন্তানকে ইসলামী শিক্ষা না দিলে পরবর্তী সময় তা তাকে বিপথে, এমনকি জঙ্গিবাদে ঠেলে দিতে পারে। ইসলামে মানবতার যে মহান শিক্ষা আছে, তা দেশের সব মুসলিম শিশুকে যথাযথভাবে না জানানোর কারণে অনেক শিক্ষার্থীই আজ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। এদের মতো অনেক জঙ্গিই এমন, যারা ‘আধুনিক শিক্ষা’র নামে ইসলামী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই জঙ্গি হয়েছে। আপনিই কিন্তু আপনার সন্তানের প্রথম আদর্শ। সন্তানের ভালো কাজের একটা অংশ যেমন মা-বাবা পেয়ে থাকেন, তেমনি সন্তানের পদস্খলনের দায়ভার আপনাকেই নিতে হবে। হাদিসে এসেছে, ‘জান্নাতে কোনো কোনো ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি করা হলে তারা বলবে কীভাবে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি পেল? তখন তাকে বলা হবে, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ক্ষমাপ্রার্থনার ফলে’ (ইবনে মাজাহ)।

রিচার্ড এডওয়ার্ড (বিখ্যাত নাট্যকার) তার ‘দি এক্সিলেন্ট কমেডি’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, স্ট্রাইক হোয়াইল দি আয়রন ইজ হট। অর্থাৎ লোহা গরম থাকতে থাকতে পেটাও! দেরি করো না। যখন ঠান্ডা হয়ে যাবে। ঠান্ডা লোহা কথা শুনবে না। তখন আফসোস হবে, দা-কুড়াল হবে না।

মানবশিশু ছোট সময় যা শেখে সারা জীবন তা তার হৃদয়ে বদ্ধমূল থাকে। তাই উদাসীনতা নয়; মা-বাবার জন্য দোয়া করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে ছোট সময়েই। আপনার-আমার সবার পরিবারে দ্বীনচর্চা হোক, শিশুকে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিই। আগামীর পৃথিবী হোক সুন্দর। নৈতিক বলে বলীয়ান হোক আমাদের আগামী প্রজন্ম।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক

পানাহার ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, কিশোরগঞ্জ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close