মোহাম্মদ আবু নোমান

  ১৩ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

আমরা লজ্জিত ও শোকার্ত

খুবই কষ্টদায়ক ঘটনা; যা চরম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। এ অনভূতি ব্যক্ত করার নয়। এ অসহ্য তিক্ত বেদনাদায়ক খবর পড়ে এমন কেউ নেই, যার মন ভারাক্রান্ত হয়নি। ওবায়দুর রহমান ও তার পরিবারবর্গ- আমরা লজ্জিত, অনুতপ্ত ও শোকার্ত। আমাদের ক্ষমা করুন। একজন ব্যক্তিকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ১৩ বছর লাগল? এটাই আশ্চর্য ও বিস্ময়কর! বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা যে কত দুর্বল ও ধীরগতির, ওবায়দুর রহমান তার জীবন দিয়ে সবার কাছে জানান দিয়ে গেলেন। ওবায়দুর রহমানের মৃত্যুতে প্রমাণ হলো, বিচারের নামে কত বড় অবিচার। বিলম্বিত বিচার অবিচারেরই নামান্তর। এ আমার দেশ, সব সম্ভবের দেশ! সরকারি প্রতিষ্ঠানে যারা আছেন, তারা সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য করতে পারেন। রাতকে দিন, দিনকে রাত করতে পারেন। স্বর্ণকে তামা আর কয়লাকে ময়লা করতে পারেন। ব্যাংক, শেয়ার বাজার, রিজার্ভকে খালি করতে পারেন।

ঘটনা : ১৩ বছর জেল খাটার পর নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ফাঁসির দ-াদেশ থেকে খালাসের আদেশ কারাগারে পৌঁছানোর আগেই মারা যান সাতক্ষীরার ওবায়দুর রহমান ওরফে অবেদ আলী (৬৫)। স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন বলেছেন, ‘বাবা ফাঁসির আসামি হওয়ায় তার স্নাতকোত্তর পাস করা দুই মেয়েকে ভালো জায়গায় বিয়ে পর্যন্ত দিতে পারেননি। ছেলে স্নাতকোত্তর করে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিনা অপরাধে তার স্বামীকে একরকম চিকিৎসা ছাড়াই ধুঁকে ধুঁকে মরতে হলো। মাত্র চার কাঠা জমির ওপর ভাঙা ঘরে তিন সন্তানকে নিয়ে অভিভাবকহীনভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে তাদের।’

ঘটনাটি পুরো জাতির জন্য লজ্জা ও কলঙ্কের। আম্বিয়া খাতুন ও ছেলে-মেয়েদের বোবা কান্না, আর্তনাদ ও হৃদয়ের রক্তক্ষরণের মূল্য কে দেবে? এর দায় কেউই এড়াতে পারবে কী? দায় কারো না কারো থাকবেই। রাষ্ট্রকেই এর দায় নিতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তার স্ত্রী সন্তানদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। যারা মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তদন্তে গাফিলতি থাকলে পুলিশ সদস্যদের বিচার করতে হবে। ওবায়দুরের ছেলে শেখ আশিকুর রহমান জানিয়েছেন, আদালত থেকে খালাসের আদেশ যাতে তাড়াতাড়ি পৌঁছায়, এ জন্য তিনি গত ৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন। খালাস আদেশ কারাগারে না পৌঁছানোয় বাবাকে ৬ মাসের বেশি সময় আটক থাকতে হয়। ওবায়দুরের স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন জানান, তার স্বামী বিনা দোষে ১৩ বছর জেল খেটেছেন। তিনি তার নিরপরাধ স্বামীর জেল খাটা ও যথাযথ চিকিৎসা ছাড়াই মারা যাওয়ার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

ইতোপূর্বে বিনা বিচারে ২৫ বছর কারাভোগের পর বেকসুর খালাস পেয়ে ‘কেউ কি আমার যৌবন ফিরিয়ে দিতে পারবে?’ এ কথা বলেছিলেন কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরের বাহারনগর গ্রামের মো. বাবুল। বয়স, পিতার নাম ও গ্রামের মিল না থাকার পরও শুধু নামের মিল থাকায় পিরোজপুরের ভা-ারিয়া উপজেলার হেতালিয়া গ্রামের চা-বিক্রেতা কাওছার উকিলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের সময় কাওছার বলেছিল তার নামে কোনো মামলা নেই। তারপরও বিষয়টি আমলে না নিয়ে যাচাই-বাছাই না করে তাকে গ্রেফতার করে। কাওছারের পাঁচ সদস্যের পরিবার চলত ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে চা বিক্রি করে।

শুধু সাতক্ষীরার ওবায়দুর, পিরোজপুরের কাওছার আর কুমিল্লার বাবুল নয়Ñখোঁজ নিলে দেখা যাবে, এভাবে অনেকেই জেলের প্রকোষ্ঠে জীবন কাটাচ্ছেন। নিছক কারণ দেখিয়ে কিংবা পুলিশের ভুল গ্রেফতারের স্বীকার হয়ে। এমনকি অনেক আছে, হয়তো যাদের পরিবারও জানে না, তাদের সন্তান জেলে বন্দি। দেশে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লেও পুলিশের কাছে যেতে ভয় পায়। অনেক সময় তারা নির্যাতিত ও দুর্বলের পাশে না দাঁড়িয়ে চোর, ডাকাত থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, অপহরণকারীসহ অপতৎপরতার হাতকে শক্তিশালী করে। আমজনতার কথা বাদই দিলাম। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদেরও পুলিশের হাতে নাজেহাল হতে হয়। অপরাধ দমন করা যাদের দায়িত্ব, তারা নিজেরাই যখন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে, তখন আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হবে কীভাবে? সাধারণ মানুষ যখন নিরুপায় হয়ে পুলিশের কাছে আশ্রয় নেয়, তখন পুলিশ তাদের সহায়তায় এগিয়ে না এসে উল্টো হয়রানি করে। অনেক পুলিশ সদস্য বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার চেয়ে পকেট ভারী করতে ব্যস্ত। তবে সব পুলিশই যে অন্যায় করে, তা বলা হচ্ছে না। অপরাধী না হয়েও নামের মিলে জেল ও নিরীহকে ফাঁসানোর ঘটনা ভবিষ্যতে যে আবারও হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী?

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close