সাধন সরকার

  ০১ আগস্ট, ২০১৮

বিশ্লেষণ

বাঘ রক্ষায় বাংলাদেশ

বছর যাচ্ছে আর সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমছে! পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন-জঙ্গল ধ্বংস ও মানুষের নেতিবাচক কর্মকা-ের কারণে অনেক বন্যপ্রাণী বহু আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। আবার কোনো কোনো বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশ থেকে ঈগল, বনমহিষের মতো অনেক বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। শকুনও বিলুপ্তির পথে। এখন শঙ্কা দেখা দিয়েছে ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ বা সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে! বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর ও আকর্ষণীয় প্রাণী হচ্ছে বাঘ। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের বাঘ মূলত ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ নামে খ্যাত। বাঘ কমে যাওয়ার পেছনে বাঘের খাদ্য ও আবাসস্থলের সংকট, পাচারকারী ও শিকারিদের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ মানুষের নানা অসচেতনামূলক কর্মকা-ই দায়ী। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ের বিভিন্ন জরিপ বলছে, গত ৪২ বছরে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। সরকারের বন বিভাগের জরিপে ২০০৪ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি।

একই সংস্থার জরিপে ২০১৫ সালে বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৬টি। বেসরকারি বিভিন্ন জরিপেও মোটামুটি একই রকম তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুন্দরবন ও এর বন্যপ্রাণী তথা বাঘ নিয়ে যত জরিপ বা গবেষণা হয়েছে, তাতে বাঘের সংখ্যা কমবেশি ৩০০-এর মতো উল্লেখ করা হয়েছে। হঠাৎ করে ২০০৪ সালের এক জরিপে বাঘের সংখ্যা এক লাফে ৪০০ হয়ে গেল! আদৌ বাঘের সংখ্যা বেড়েছিল নাকি বাড়িয়ে বলার প্রচেষ্টা! ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে যুক্তরাজ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত ‘সুন্দরবনের বাঘ সমীক্ষায়’ বলা হয়েছে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১২১টি। বিভিন্ন জরিপে যেভাবেই বলা হোক না কেন, এ কথা সত্যি, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। কিন্তু বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের চিত্র ইতিবাচক। বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিলের (ডব্লিউডব্লিউএফ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ২০০, আর ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৮৯০। বাঘের সংখ্যা বেড়েছে এমন দেশের মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, ভারত ও নেপাল। ‘গ্লোবাল টাইগার ইনিশিয়েটিভের’ (জিটিআই) এক তথ্য মতে, বিশ্বের মোট বাঘের প্রায় ৮৫ শতাংশের বেশি বিংশ শতাব্দী শুরুর পর হারিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের জাতীয় বন সুন্দরবন। বিশ্বে বাংলাদেশ ‘সুন্দরবনের দেশ’ হিসেবেও অধিক পরিচিত। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যে দেশের জাতীয় বনে জাতীয় পশু থাকে। সুন্দরবনের সৌন্দর্যের প্রতীক ও সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাণী বাঘ কমতে থাকলে সুন্দরবন ভালো থাকবেÑএমনটি মনে করার কারণ নেই। সুন্দরবন ও বাঘ একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু সুন্দরবন ও এর আশপাশের পরিবেশ এখন বদলে যাওয়া শুরু করেছে। ধীরে ধীরে বনের আশপাশে গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্পকারখানা। বনের ভেতর দিয়ে এখন প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় নৌযান চলাচল করছে। ফলে বাঘের স্বাভাবিক জীবনাচরণে সমস্যা হচ্ছে। আগে এমনটি ছিল না। আবার বনে চোরাশিকারিদের সংখ্যা বাড়ছে। বাঘের আবাসস্থল নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশ-বিদেশে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চাহিদা থাকায় বাঘ পাচারকারীরা সময়-সুযোগ বুঝে বাঘ হত্যা করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনে বাঘের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবনে প্রতি বছর কমপক্ষে চার-পাঁচটির বেশি বাঘ হত্যা করা হয়। পশুরা কথা বলতে পারে না, কিন্তু তাদের বোবা কান্না প্রকৃতি ঠিকই শুনতে পায়। শুধু শুনতে পান না বন ও বাঘ রক্ষার দায়িত্বে কর্তাব্যক্তিরা। ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন ইতিহাস ও প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, আগে এ বঙ্গ অঞ্চলে ছোট-বড় সব গ্রামীণ বন-জঙ্গল (কিছু দ্বীপাঞ্চল বাদে) ও অন্যান্য বনাঞ্চলে চিতাবাঘ বাস করত। কিন্তু এখন বলতে গেলে শুধু সুন্দরবনেই টিকে আছে।

বাঘ নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের লোগোতে বাঘের ছবি আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল জিতলে খবরের শিরোনাম হয় : ‘বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব’ বা ‘এবার টাইগারদের জয়’। সময় থাকতে বাঘ রক্ষায় আমাদের এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বন বিভাগের সম্প্রতি (২০১৬ সালের) এক গবেষণা বলছে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গত সাত বছরে ৪২ হাজার বন্যপ্রাণী পাচারের সময় আটক হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি বাঘ ও তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গও রয়েছে। না জানি প্রতি বছর আরো কত বন্যপ্রাণী সবার অগোচরে পাচার হয়! চোরাশিকারিদের ধরে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এমনিতেই পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বন ও বন্যপ্রাণীদের ওপর পড়তে শুরু করেছে। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থেই বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগও জোরোশোরে নেওয়া হচ্ছে। ২০১০ সালে রাশিয়ায় ‘বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে’ ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ রয়েছে। বাংলাদেশও এ সংখ্যা দ্বিগুণ করবে। কিন্তু সত্য হলো, বাংলাদেশ বাঘ রক্ষায় সঠিক পথে নেই। সুন্দরবন কেমন আছে, তা বোঝা যায় বাঘের সংখ্যা দেখে। প্রয়োজনে যেসব দেশে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে, সেসব দেশের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। বন রক্ষাসহ বাঘের বসতির নিরাপত্তা ও বাঘ রক্ষার তদারকি বাড়াতে হবে। বাঘ রক্ষার পাশাপাশি বাঘের সংখ্যা বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে সুন্দরবন থেকে বাঘ চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখনই বাঘ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist