ডা. এস এ মালেক
পর্যালোচনা
মেয়র নির্বাচন ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন
বাংলাদেশে নির্বাচন হলেই নানা রকম প্রশ্ন ওঠে। এখানে সব সময় যে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে, বাস্তবতা তা নয়। এখানে নির্বাচন কারচুপি হয়, ব্যালট বাক্স চুরি হয়, একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে যায়Ñএরূপ অভিযোগ চলেই আসে। যারা সরকারি দল, তাদের অভিযোগটা একটু বেশিই হয়। সুতরাং সরকারি দল আর বিরোধী দল যেই হোক না কেন, এরূপ দাবি কেউ করতে পারবে না যে তাদের আমলে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নিয়মেই হয়েছে।
এ আলোকেই পরপর দুটি মেয়র নির্বাচন প্রথমে খুলনা ও পরে গাজীপুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ কথা বলতেই হবে, এ দুটি নির্বাচনে যদিও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, দৃশ্যত মানুষ দেখেছে হাজার হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছে। অধিকাংশ কেন্দ্রে কোনো গোলযোগ হয়নি। কোনো কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ হয়নি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়নি। দু-চারটি কেন্দ্র ছাড়া অধিকাংশ কেন্দ্রেই সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। উভয় নির্বাচনে যে কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করছে, তারাই বলেছে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। ১০০ ভাগ না হলেও ৮০ ভাগ তো হয়েছে। তাই বিএনপির স্বভাবসুলভ যে আচরণ নির্বাচন রায় প্রত্যাখ্যান করা, তা কিন্তু এবার তারা করতে পারেনি। দুটি নির্বাচনে নেতারা বিশেষ করে প্রার্থীরা মূল অভিযোগ তুলেছেন যে নির্বাচন একেবারেই সুষ্ঠু হয়নি। মারাত্মকভাবে কারচুপি করা হয়েছে। কিন্তু প্রচারমাধ্যমে বিশেষ করে টিভির পর্দায় নির্বাচন প্রক্রিয়ার যে দৃশ্যমান ছবিগুলো দেখা গেছে তাতে মনে হয়নি যে বিএনপির দাবির পেছনে কোনো সত্যতা আছে। বরং স্বভাবসুলভভাবে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নানা ধরনের টালবাহানা করছে। বিএনপির শাসনামলে যেসব নির্বাচন হয়েছে, যেমন মাগুরার উপনির্বাচন। ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন তাকে তো নির্বাচনেই বলা যায় না। আ.লীগের শাসনামলে ওইরূপ একটা নির্বাচন হয়েছে বলে কেউ দাবি করতে পারে না। ২০০১ সালে ষড়যন্ত্রের কারণে নির্বাচনে পরাজিত হয়েও শেখ হাসিনা যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন, নির্বাচনের রায় মেনে নিয়েছিলেন সেরূপ দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের আর কোনো দল দিতেই পারবে না। গাজীপুর নির্বাচনের প্রায় দুদিন আগে প্রায় সাড়ে চার হাজার লোকের সামনে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দিয়েছেন, তাই প্রমাণ করে যে তার আন্তরিকতাটা কিরূপ ছিল। আসলে এ দুই মেয়র নির্বাচনে আ.লীগ প্রার্থীর বিজয়ী হওয়ার কারণ হচ্ছে দুজনই যোগ্য প্রার্থী। খুলনার তালুকদার আবদুল খালেক একেবারেই নবীন লোক নন। তার বয়স ৬০-এর ঊর্ধ্বে। দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে তিনি যেভাবে দুর্যোগ মোকাবিলায় দক্ষতা ও কঠোর পরিশ্রমে তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং একজন সৎলোক হিসেবে তার যে সুনাম তা খুলনার লোকজন ভুলেনি। তাই তারা মেয়রের দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করেছেন।
আর গাজীপুরে আ.লীগের প্রার্থী তার থেকে একধাপ ওপরে। তরুণ যুবসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি তার সব কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। কথাবার্তা ও চালচলনে যে মডারেটর এবং বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার বিপরীতে একজন বৃদ্ধ অসহিষ্ণু, শারীরিকভাবে বেশ কিছুটা অসুস্থ। কোনো কমিটমেন্ট ছিল না বললেই হয়। তাকে মানুষ নির্বাচিত করতে যাবে কেন? একটা শিল্পনগরী চরমভাবে অবহেলিত, উপেক্ষিত, যানজটে বিপর্যস্ত, শ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষ অধ্যুষিত এলাকার পুনর্গঠনে জাহাঙ্গীর আলম যে বিএনপির প্রার্থী থেকে বেশি যোগ্য তা বুঝতে গাজীপুরবাসীর বুঝতে অসুবিধা হয়নি। দুই নির্বাচনে সরকারি দল ও বিরোধী দলের ভোটের ব্যবধান প্রমাণ করে, সাধারণ মানুষ দেশের উন্নয়নের স্বার্থে প্রার্থীদের চেয়েও বেশি তাকিয়েছিল শেখ হাসিনার অবিশ্বাস্য উন্নয়ন প্রক্রিয়ার প্রতি। দেশব্যাপী উন্নয়নের জোয়ার, তাতে করে ওই উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে সরকারি দলকে ভোট দেওয়া তারা বাঞ্ছনীয় মনে করেছেন। জাহাঙ্গীর আলম তার নির্বাচনের বক্তৃতায় বারবার বলেছেন, তিনি কী করবেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন। সহনশীল এই যুবক এমনকি নির্বাচনে বিজয়ের পরও তার প্রতিপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তিনি শুধু আ.লীগের মেয়র নন। নির্বাচিত হওয়ার পর গাজীপুরের সবার সংযত থাকা উচিতÑসংঘাত নয় সমঝোতাই তার নীতি। তিনি কেন, সবাই তো বুঝতে পেরেছিলেন যে নির্বাচনী আবহাওয়া তার অনুকূলে। যেভাবে নারী ও যুবক ভোটাররা তার পক্ষে কাজ করেছেন, তাতেই তো বোঝা গিয়েছিল তিনিই মেয়র হওয়ার যোগ্য প্রার্থী। বিএনপি নেতা হুমকি দিয়েছিলেন তিনি পরাজিত হলে গাজীপুরে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেন। কিন্তু নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার মতো বাস্তব অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। তাই তাকে নির্বাচনের রায় মেনে নিতেই হবে। যেসব অনিয়মের অভিযোগ তিনি তুলেছেন, তা প্রমাণিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। তাই তার উচিত হবে জাহাঙ্গীর আলমের ডাকে সাড়া দেওয়া। তাহলে উপেক্ষিত গাজীপুর উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।
এ দুটি মেয়র নির্বাচনের আলোকে যদি আমরা ভবিষ্যৎ জাতীয় নির্বাচনের দিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে মোটামুটি বলেই দেওয়া যায় আগামী নির্বাচনের মূল ফ্যাক্টর হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যাকেই মনোনয়ন দেবেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণ তাকেই নির্বাচিত করবেন। কেননা জনগণ বিশ্বাস করেন শেখ হাসিনা একমাত্র সেই নেত্রী যিনি দেশ এবং জাতিকে এমন একটা অবস্থানে পৌঁছে দিতে সক্ষম, যার সুফল প্রতিটি জনগণ উপভোগ করবেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, নারীর অধিকার, দারিদ্র্যবিমোচন, মাদকবিরোধী আন্দোলন, স্বাস্থ্যসেবা, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকরণ, জাতীয় ক্ষেত্রে প্রতিটি সংকট সমাধান করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা একমাত্র শেখ হাসিনাই পেরেছেন। তাই হয়তো জনগণ নৌকায় ভোট দিয়ে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসবেন। আ.লীগের নির্বাচনী বিজয়ী ট্রেন এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে আরোহণ করার সুযোগ বিরোধী দলের আছে বলে মনে হয় না। তাদের দাবি, বেগম জিয়াকে মুক্ত করা। বেগম জিয়া যদি মুক্তি পেয়ে নির্বাচনের মাঠে অবতীর্ণ হন, তখন নতুন করে হয়তো প্রশ্ন উঠবে এতিমের টাকা যিনি মারতে পারেন, তিনি আবার ক্ষমতা দখল করতে চান কেন? প্রশ্ন উঠবে, ১৫ আগস্ট জন্মদিবস না হলেও জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে তা পালন করা। প্রশ্ন উঠবে তার পরম ¯েœহময় ছেলের কুকীর্তির কথা। প্রশ্ন উঠবে বিএনপি আমলের আর্থ-সামাজিক দুরবস্থার কথা। কীভাবে তিনি এই ভাবমূর্তি নিয়ে নির্বাচনে শেখ হাসিনার মুখোমুখি হবেন। তাই স্পষ্টতই বলা যায়, আ.লীগ সরকার যদি তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পারে, তাহলে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করবে। কারচুপি করে আ.লীগের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
"