অলোক আচার্য্য

  ২০ জুন, ২০১৮

বিশ্লেষণ

দিবসে বন্দি ভালোবাসা

আজ দেশ-বিদেশে কত দিবস পালিত হয়, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এসব দিবস ঘটা করে পালন করা হয়। এসব ভালোবাসার জন্যও দিবস দরকার হয়। সেই দিবসে নাকি ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। দিবস গেলেই ভালোবাসা উধাও। কত আয়োজন হয় তার হিসাব নেই। অথচ কি আশ্চর্য! প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট ভালোবাসার হওয়া উচিত। কিন্তু সেটাকেও আমরা একটি নির্দিষ্ট দিনে বন্দি করে ফেলেছি। আছে মা দিবস, যা মাত্র কয়েকদিন আগে চলে গেছে। আর বাবা দিবস চলে গেল ঈদ আনন্দের ভেতর। প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস পালিত হয়। কিন্তু মা-বাবার জন্য ভালোবাসার আলাদা কোনো দিবসের প্রয়োজনই হয় না। যে সম্পর্ক রক্তের সে সম্পর্ক কোনো নির্দিষ্ট দিনে পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু আমরা মা দিবসে মাকে আলাদা করে ভালোবাসি, বাবা দিবসে বাবাকে আলাদা করে ভালোবাসার চেষ্টা করি।

মা এবং বাবার ভালোবাসাকে আলাদাভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করা হলেও মূলত একে অপরের পরিপূরক। কোনো শিশু সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য মায়ের ভালোবাসা যেমন দরকার, তেমনিভাবেই দরকার মায়ের ভালোবাসা। আসলে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য একটি ভালোবাসার পরিবেশ খুবই জরুরি। সন্তানকে পরম মমতায় স্নেহে বুকের সঙ্গে ধরে রাখেন বাবা। বাবার মমতা আর ছায়ায় পরম নির্ভরতায় শিশু বড় হয়ে ওঠে। বাবা-মায়ের যে অবদান তা যেন একটি দিবসে সীমাবদ্ধ রেখে আমরা সংকীর্ণতা না দেখাই। কিন্তু সন্তান মা-বাবার এই পরম মমত্বটুকুর দাম কমই দেয়। আজকাল অবশ্য সেই হার বাড়ছে। দেশে এখন গুনলে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা অনেক পাওয়া যাবে। এসব বৃদ্ধাশ্রমে যারা বাস করে তারাও কারো না কারো মা-বাবা। এসব মা-বাবা কোন দিবস বোঝে না। বোঝে কেবল সন্তানের মুখ। বছরের একটি দিন হলেও সন্তানকে কাছে পাওয়ার আকুল প্রার্থনা থাকে মনে। কারো সন্তান দয়া করে সে চাওয়া পূরণ করে আবার কারো ভাগ্যে তাও জোটে না। তখন এসব দিবসকে বড় অসহায় মনে হয়। মনে হয় এসব দিবস একটা বড় ধরনের প্রহসন। অবাক ব্যাপার হলো, এখানে এমন সব সন্তানের মা-বাবার দেখা মেলে, যারা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নামিদামি মানুষ হিসেবে পরিচিত। যাদের জীবনের পুরো অবদানটাই মা-বাবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই মা-বাবার অবদান ভুলে যায় এসব অকৃতজ্ঞ সন্তান। মাঝেমধ্যে পত্রিকার পাতায় কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার কোনো রেলস্টেশন বা বাসস্ট্যান্ডে পড়ে থাকার খবর দেখি। তখন সত্যিকার অর্থে সেই সন্তানদের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা জন্মে।

প্রতিটি দিবস পালনের পেছনে কিছু ইতিহাস থাকে। বাবা দিবস পালনের পেছনেও কিছু ইতিহাস রয়েছে। যতদূর জানা যায়, বিশ্বের ৫২টি দেশে বাবা দিবস পালন করা হয়। ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় প্রথম বাবা দিবস পালিত হয়। এ ছাড়া নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯১৩ সালে আমেরিকার সংসদে বাবা দিবসে ছুটির জন্য একটি বিল উত্থাপিত হয়। ১৯২৪ সালে সে সময়কার প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে সমর্থন দেন। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন বাবা দিবসে ছুটি ঘোষণা করেন। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস পালন করা হয়। সে হিসেবে এবারের বাবা দিবস ঈদের আনন্দের সঙ্গে মিলে গেছে। আমি জানি তারপরও সব সন্তান দিবসটিকে মনে রেখেছে। বিভিন্ন দিবস পালন এখন একটি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। সে হিসেবে বাবা দিবস বা মা দিবস পালন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে শুধু দিবস পালন নয় বরং সত্যিকারের ভালোবাসা শ্রদ্ধা দিয়ে দিনটি কতজন পালন করে, সেটাই দেখার বিষয়। কোনো বিশেষ ঘটনাকে দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে অনেক ইতিহাস এবং ঘটনাক্রম জড়িত থাকে। একদিন বা কেবল আবেগের মোহে কোনো বিশেষ দিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না এবং সেই দিবসটি একসময় হয়ে ওঠে আবেগের প্রতীক। বাবা দিবস পালনের ক্ষেত্রেও ঠিক এ রকমটা ঘটেছে। কিন্তু কেবল দিবসের ভেতর সীমাবদ্ধ রেখে তো ভালোবাসা প্রকাশ করা যায় না। তা ছাড়া এখন শ্রদ্ধাবোধের যতটা আকাল এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যতটা অবিশ্বাস আর দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে, তাতে দিবস না পালন করেও কোনো উপায় নেই। অন্তত একদিন হলেও অনেক সন্তান তার বাবার কথা মনে পড়ে। সারা বছর তো তার অনেক কাজ থাকে! বাবার কথা মনে করার সময় কোথায়। কিন্তু যে হারে পারিবারিক দূরত্ব বাড়ছে, তাতে এসব সম্পর্ক কেবল দিবসেই থেকে যাবে, যা বছরান্তে একবার পালন করা হবে। পারিবারিক সম্পর্কের যে নড়বড়ে অবস্থা, আমাদের সমাজে আজ বিরাজ করছে তাতে কোনো ভাই দিবস বা বোন দিবস চালু হলেও কোনো আশ্চর্যের বিষয় হবে না। আবার বছর জুড়ে যত জাতীয় বা আন্তর্জাতিক দিবস রয়েছে বা আরো নতুন নতুন দিবস আত্মপ্রকাশ করছে, তাতে সন্দেহ হয় যে এই দিবস পালন করার জন্য কোনো দিবস ঘোষণা করা হয় কি না।

মায়ের আঁচল যদি হয় সন্তানের আশ্রয় আর শান্তির প্রতীক, তাহলে বাবার বুক হলো সন্তানের পরম নির্ভরতার প্রতীক। বাবা বেঁচে থাকা পর্যন্ত বটগাছের মতো সন্তানসহ সংসারটাই বুক দিয়ে আগলে রাখে। প্রয়াত নান্দনিক কথাসাহিত্যিক একসময় বলেছিলেন যে, পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই। যে সত্যিকার অর্থেই বাবা সে কোনোদিন খারাপ হতে পারে না। কেবল সন্তান জন্মদান করেই বাবার অধিকার লাভ করতে গেলেই তাকে বাবার দায়িত্ব বলা যায় না। বরং বুক দিয়ে চিরটাকাল সন্তানকে সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেই বাবার দায়িত্ব পালন করতে হয়। কোনো এক লেখায় বাবার ভালোবাসা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। এমনকি মহত্ত্বেরও কোনো লেখা দ্বারা সম্পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব না। তার অংশটুকুই কেবল উঠে আসে। মা-বাবার স্নেহপূর্ণ বাধনে সন্তানের জীবন পূর্ণতা পায়। কোনো একজনের ভালোবাসা না থাকলেও সন্তানের এক অংশ অপূর্ণতা থেকে যায়। আর দিবস দিয়ে কি কোনো কাজের মূল্যায়ন করা যায়। প্রতি বছর মা দিবস আসবে, বাবা দিবস আসবে আবার এসব ভালোবাসার জন্য একটা ভালোবাসা দিবসও আসবে। তবে আজ যে সন্তানের সঙ্গে মায়ের, বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে, তার বৈষম্য কি কেবল একদিন ভালোবাসলেই শেষ হবে। তা কোনোদিন সম্ভব নয়। দিবস কেবল মনে করাতে পারে ভালোবাসা শেখাতে পারে না। অন্তর থেকে যদি মা-বাবাকে শ্রদ্ধা না করা যায়, তাহলে কোনো দিবসে একটি মেসেজ দিয়ে বা কোনো গিফট দিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করা যায় না। আত্মিক বন্ধন আত্মা দিয়েই পরিমাপ করতে হয়। দিবসে বন্দি করা ভালোবাসা দিয়ে তার কমই মূল্যায়ন করা যায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist