মোহাম্মদ আবু নোমান
মতামত
এভাবেই কাঁদতে চাই
দেশে ঘুষ ছাড়া চাকরি কতটা দুষ্প্রাপ্য, এ কান্না তার প্রমাণ। বর্তমান সময়ে যা অকল্পনীয়, অচিন্তনীয় ও অভাবনীয় ঘটনা। ঘুষ ছাড়া চাকরি! সোনার বাংলায় এটাও আবার তাহলে সম্ভব? এত দিন কি তাহলে সব চাকরি ঘুষ দিয়ে হয়েছে? আজ ঘুষ ছাড়া হয়েছে মানে আগে ঘুষ লাগত? বগুড়ায় পুলিশ কনস্টেবল পদে পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হওয়া প্রার্থীর অনেক অভিভাবকের দাবি, এবার ঘুষ ছাড়াই চাকরি হয়েছে। সন্তানদের ঘুষ ছাড়াই চাকরি হয়েছে এই খুশিতে শতাধিক অভিভাবক বগুড়ার পুলিশ সুপারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় অনেকে আনন্দে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন।
এমন কান্না, এভাবে আমরা বারবার কাঁদতে চাই। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে, ঘুষ ছাড়া চাকরি পেয়ে যেমন অনেক তরুণ-তরুণী ও অভিভাবক আজ কাঁদলেন, তদ্রƒপ ঘুষ ছাড়া চাকরি না পেয়ে দেশের হাজার হাজার অভিভাবক এখনো কাঁদছেন। অভিভাবকদের উদ্দেশে পুলিশ সুপার মো. আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, শতভাগ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় এবারে কুলি, শ্রমিক, ভ্যানচালক, ভূমিহীন বর্গাচাষি, দিনমজুর ও ডাব বিক্রেতার সন্তানরাও নিয়োগের জন্য উত্তীর্ণ হয়েছেন।
আমাদের দেশে সব পুলিশ যদি পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞার মতো হতো, তাহলে দেশটা বহু আগেই অনেক দূর এগিয়ে যেত। ভালো মানুষ সব সেক্টরেই আছে, তবে সংখ্যাটা নিতান্তই কম। ভালো কাজকে ভালো বলেই গণ্য করতে হবে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সে যেই করুক। সবকিছু দলীয়ভাবে দেখলে চলবে না। আলী আশরাফ ভূঞার এই কাজকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে। দেশব্যাপী এর সঙ্গে পুলিশ দ্বারা হয়রানি কমিয়ে আনতে পারলে ধীরে ধীরে পুলিশ মানুষের আস্থার জায়গা দখল করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। পুলিশের চাকরির মতো সরকারি অন্যান্য চাকরির বেলায়ও ঘুষ ছাড়া লোক নিয়োগ করতে হবে।
ঘুষখোর হানাদার বাহিনীর চেয়েও নিকৃষ্ট, তারা বাঙালি জাতিকে একসময়ই মেরেছিল। আর ঘুষখোররা প্রতি পদে পদে স্বাধীন দেশের সাধারণ মানুষদের মারছে। ঘুষ ছাড়া চাকরি বিশ্বের সর্বত্রই স্বাভাবিক ও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হলেও বাংলাদেশে তা আকাশের তারা হাতে পাওয়ার সমতুল্য। এটা বিরাট আশার কথা। এই দৃষ্টান্ত সর্বত্র প্রয়োগ হবে এ আশাই সর্বসাধারণের। পৃথিবীর অন্য দেশ পারলে আমরা পারব না কেন? বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা প্রমাণ করলেন আমরাও পারি সৎ পথে চলতে।
তবে এ কথা ঠিক, ঘুষ ছাড়া চাকরি হলো এটা যেমন সত্যি, আবার বেশির ভাগ জায়গায় ঘুষ ছাড়া চাকরি হচ্ছে না, এটাও সত্যি। এই ঘুষ ছাড়া চাকরি যেন, ঘুষ খাওয়া ছাড়া চাকরির জীবন হয়, তাহলেই একদিন বাংলাদেশের সব বদলে যাবে।
এ ধরনের সংবাদ সত্যি আশাজাগানিয়া। বেশির ভাগ তরুণের জীবনের সঙ্গে মিলছে না। এটাও আবার সম্ভব নাকি? পুলিশ সুপার আলী আশরাফ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, যা তার ক্যারিয়ারের জন্য গর্বের কারণের সঙ্গে অধস্তন অন্য তরুণ অফিসারদের রোল মডেলসহ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। নষ্ট সময়ে চারপাশ যখন কালো ছায়ায় ঢেকে গেছে, তখন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গোস্সা, সুপারিশ ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এ ধরনের নিয়োগের ঘটনা পরিবর্তনের বার্তা দিয়ে যায়। যদিও পুলিশ সুপার আলী আশরাফের ডুবন্ত তরী উদ্ধারে ক্ষুদ্র চেষ্টামাত্র। তার পরও অনেক তরুণ-তরুণী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, ‘পুলিশ সুপার আলী আশরাফকে সহস্র স্যালুট ও তার পায়ে সালাম।’ আসলে যেকোনো দৃষ্টান্তকে উৎসাহিত করা হলে সেটা ভবিষ্যতে অন্যদের পরিবর্তনের সূচনার কারণ হতে পারে। তা ছাড়া ঘুষ ছাড়াও চাকরি হয়, এ কথা আমাদের মেন্টালিতে গেঁথে নিলে হয়তো অনেকেই সেই আশায় ভালো কিছু করার চেষ্টা করবে। অনেকে হয়তো এ কথা বিশ্বাস করে, ঘুষ দিতেও অনাগ্রহী হবে।
ঘুষ ছাড়াই চাকরি প্রাপ্য এবং যারা পেয়েছেনও। এখন ঘুষ ছাড়া সেবাও জনগণের প্রাপ্য। যাদের টাকা ছাড়া চাকরি হয়েছে, জনগণ আশা করে তারা কখনোই খারাপ পথ অবলম্বন করবেন না। নিয়োগের পর তারা কেউ ঘুষ খাবে না, এই নিশ্চয়তা দিতে হবে। এমনটা যেন না হয়, আজ যারা ঘুষ ছাড়া চাকরি হওয়াতে খুশিতে কাঁদছেন, তারাই একদিন ঘুষ নিয়ে কতজনকে কাঁদাবেন। যেভাবে তারা কোনো দুর্নীতি ছাড়া চাকরি পেয়েছেন, এভাবে নিজেদের চরিত্রও দুর্নীতিমুক্ত রাখবেন। এ ছাড়া আপনাদের দারা জনগণের জানমালের ক্ষতি হবে না। এভাবে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ হলে। তাহলেই ক্ষুদামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ পাওয়া সম্ভব।
বগুড়ার কুলিশ্রমিক তোতা শেখ, বর্গাচাষি তফসির উদ্দিন, ভ্যানচালক শাহিদুল ইসলাম, হতদরিদ্র গৃহবধূ ফাতেমার স্বামী শারীরিক প্রতিবন্ধী মুকুল মিয়া, জান্নাতুল পারভীনের মা সালমা বেগম ও চন্দনবাইশা ডিগ্রি কলেজের পিয়ন মাইনুল ইসলামসহ যাদের সন্তানদের চাকরি হয়েছেÑ আপনার সন্তানটির যেদিন চাকরিতে প্রথম জয়েন হবে, সেদিন তার মাথায় হাত রেখে বলুনÑআজ থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজকর্মে ও চিন্তায় সৎ তোমরা থাকবে। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য পুলিশের এ চাকরিটুকু যথেষ্ট।
পরিশেষে এতগুলো মানুষের আনন্দাশ্রু আর হাসিমুখের কারণ যিনি, সেই বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞাকে আবার অভিনন্দন, অভিবাদন ও প্রীতিসম্ভাষণ। আপনি অমর, অক্ষয় থাকবেন এই ২০০ পরিবারসহ সারা দেশের মানুষের হৃদয়ে। আপনার সততা, সাধুতা, ন্যায়পরায়ণতা হোক দৃষ্টান্ত নতুন প্রজন্মের কাছে। মহান আল্লাহতায়লা আপনার মঙ্গল করুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"