নিজস্ব প্রতিবেদক ও মজিবুর রহমান খান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

  ১৩ মে, ২০১৯

ভয়ংকর আতঙ্কের পুকুর!

‘ভয়ানক পুকুর’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওয়াপদা পুকুর। আতঙ্কে এই পুকুরে গোসল করেন না এখন কেউ। বিভিন্ন সময় ৮-১০ জন মানুষ রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার হয়েছে এই পুকুরে। সর্বশেষ গত মাসে এক যুবক মৃত্যু মুখে পতিত হয়। এ কারণে পুকুরটি আসলেই প্রাণঘাতী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এলাকায়। স্থানীয় আলেম-ওলামারা পুকুরটিতে শয়তনের আসর আছে বলে ঘোষণা করেছেন। মসজিদে জুমার নামাজের বয়ানেও সতর্ক করা হয় এই পুকুর নিয়ে। তবে পেশাধার ডুবুরি এবং অভিজ্ঞ সাঁতারু মো. আতিকুর রহমান জানিয়েছেন, এই পুকুরে জিন-ভূতের কোনো ব্যাপার নেই। সবই এলাকার মানুষের যুক্তিহীন বিশ^াসের গুজব।

এই পুকুরে একের পর এক মানুষের মৃত্যু এলাকায় ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে সন্ধ্যায় ফরহাদ হোসেন নামে এক তরুণের পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন মানুষ চারপাশে দাঁড়িয়ে দোয়া-দুরূদ পড়তে থাকেন। এরপরই সে ধীরে ধীরে সাঁতরিয়ে পাড়ে আসে। শুধু পুকুর নয় ওয়াপদার ওই গোটা এলাকা দোষী বলেই মনে করেন অনেকে। ওয়াপদা মসজিদের খতিব মোজাম্মেল হক আকরামী বলেন, সেদিনের ঘটনার পর আমি সবাইকে সতর্ক করেছি এই পুকুর নিয়ে। বিশেষ করে যুবকদের। এসব ঘটনা জিন জাতির কাজ বলেও জানান তিনি।

এর আগে ২০১৭ সালে এই পুকুরে ডুবেই মারা যান শাকিব খান (১৬) নামে এক স্কুলছাত্র। পুকুরের পাড় সংলগ্ন মাঠে ক্রিকেট খেলছিল সে। বল পানিতে গিয়ে পড়ে। সেই বল কুড়াতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ওই কিশোর। শাকিবের মৃত্যুর কারণ হিসেবে পুকুরের মধ্যে বিশেষ কোনো কিছু থাকাকেই দায়ী করেন তার সহপাঠী ও এলাকার মানুষ। পুকুরের মধ্যস্থলে কিছু একটা আছে। ১৮-১৯ বছর আগে ওয়াপদার এক নৈশপ্রহরীকে পুকুরের পাড়ে মুমূর্ষু অবস্থায় পাওয়া যায়। তার জামা-কাপড় ছিল ভেজা। একদিন বাদেই মৃত্যু হয় শামীম নামের ওই নৈশপ্রহরীর। পুকুরটিতে চাষ করা মাছের এক পাহারাদারও ভয় পেয়েছিলেন। শহরের দাতিয়ারা এলাকায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিতরণ বিভাগের (ওয়াপদা) বৃহৎ আকারের এই পুকুর নিয়ে ভয়ভীতির গল্প অনেক ছড়িয়ে আছে আশপাশের মানুষের মনে। শুধু পুকুর নয় ওয়াপদার এই গোটা এলাকা দোষী বলেই জানান অনেকে। ওয়াপদার কর্মচারী বসবাসের বিল্ডিংয়ের ছাদে গভীর রাতে এখনো অনেকে শুনেন নাচ-গানের শব্দ।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিতরণ বিভাগের অফিস ও কর্মচারীদের আবাসস্থল করার জন্য ১৯৬২ সালে দাতিয়ারায় প্রায় ২৩ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৮ একর আয়তনের পুকুরটি খনন করে স্থাপনা নির্মাণস্থলে মাটি ভরাট করা হয়। এলাকাজুড়ে রয়েছে এখনো পুরোনো অনেক গাছ। তবে এই গাছের দিকেও ইঙ্গিত রয়েছে কারো কারো। তাদের ধারণা এতেই বাসা বেঁধে আছে অন্য কোনো কিছু। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর ক্যাম্প ছিল এই ওয়াপদায়। সুরক্ষিত কয়েকটি বাঙ্কার সেই স্মৃতি বহন করছে এখনো। এসব বাঙ্কারে থাকতেন পাক বাহিনীর কর্মকর্তারা। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতনও করা হতো এখানে। হাজী ইউনুছ মিয়া। ১৯৬৭ সালে ওয়াপদার চাকরি শুরু করে অবসরে গেছেন ২০০৪ সালে। দীর্ঘসময় ওয়াপদার ভেতরেই ছিল তার বাস। তারও বিশ্বাস নিশ্চয় এখানে কিছু আছে। ছেলেটা বল আনতে সাঁতরে পুকুরের মাঝখানে গেল, বলটা হাতে নিয়ে আর ফিরতে পারল না! পানিতে তলিয়ে গেল সে চোখের সামনেই। এর আগেও আমাদের এক নাইটগার্ডকে পুকুরের পাড় থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরো একটি ঘটনাও ঘটেছে।

নৈশপ্রহরী শামীম (৩৫) মারা যান সম্ভবত ১৯৯৮ সালের দিকে। রাত দেড়টার দিকে তাকে পাওয়া যায় পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণায়। নেতিয়ে পড়া ভেজা শরীর। লোকজন তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে। একদিন বাদেই মারা যান শামীম। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী রফুজা বেগমকে ওয়াপদায় চাকরি দেয়া হয়। রফুজা বলেন, আমারে অনেক দিনই বলত তার (শামীম) সামনে এসে একটা মহিলা নাকি দাঁড়াইয়া থাকত। তার বড় বড় দাঁত। আমারে আর তার মারে বলত আমি বাচতাম না। তারে (শামীম) অনেকেই বলত নামাজ পড়তে, মসজিদে যেতে। বলত সব ঠিক হয়ে যাবে। ওইদিনের ঘটনার বিষয়ে সে আমাকে জানিয়েছে, পুকুরের কোণায় সে প্র¯্রাব করতে বসেছিল। ওইসময় তার ঘাড়ে কে যেন একটা থাপ্পর মারে। কাপড়চোপর ভেজা অবস্থায় পুকুরের কোণায় পড়ে ছিল সে। হাতের টর্চলাইট পড়ে ছিল একদিকে। রফুজা বলেন, আমার সন্দেহ তারে পানিতে চোবাইছে। রাত দেড়টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। তাকে লোকজন বাসায় নিয়ে আসার পর আবোল-তাবোল বলতে থাকে। রোববার রাতে এই ঘটনা ঘটে। পর দিন সোমবার মারা যায় সে। ডাক্তার বলেছিল স্ট্রোকে মারা গেছে সে। রফুজার দাবি, জায়গাটা ভালো না। ওই জিনিসটা আছে এখানে। বলেন পরীও আছে। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর পুকুর পাহারা দিত এমন একজন মারা গেছে বলে শুনেছি।

ওয়াপদার পুরোনো গেটের পাশের বাসিন্দা আক্তারুজ্জামান। ১৯৮৫ সাল থেকে এই মহল্লায় রয়েছেন। বলেন মানুষের কাছ থেকে তো কত কিছুই শুনি। বিদ্যুতের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিতরণ বিভাগের কর্মচারী তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা আগের লোকজনের কাছ থেকে শুনেছি বিল্ডিংয়ের (কর্মচারী কোয়ার্টার) ছাদে রাতে নাচ-গান হতো। তারা কারো ক্ষতি করে না। তবে নাচ-গানের এই শব্দ এখনো পান কোয়ার্টারের বাসিন্দারা।

সাবেক নৌ সেনা ও ডুবুুরি আতিকুর রহমান জানান, এই পুকুরটা অনেক বড়, ৮ একর আয়তনের। ঝানু সাঁতারু ছাড়া এর মাঝ বরাবর গিয়ে সাঁতরে পাড়ে আসা সহজ নয়। তাছাড়া এ পুকুর নিয়ে যেহেতু এর মধ্যেই এলাকায় জিন-ভূতের গল্প নিয়ে অপপ্রচার হয়েছে সে কারণে এ পুকুরে নেমে কিছু দূর সাঁতরে গিয়ে হতাশায় শরীরের পেশি দুর্বল হয়ে তরুণ ও কিশোররা ডুবে যেতে পারে। এর আগে এখানে ডুবে যারা মারা গেছে তারা সাঁতার জানত কি না তাও পরিষ্কার নয়। এছাড়া একটা পুকুর সম্পর্কে যখন এ রকম আজগুবি জিন-শয়তানের ব্যাপারে লোকবিশ্বাস সৃষ্টি হয় তখন অপরাধীরা সুযোগ মতো কাউকে আঘাতহীনভাবে হত্যা করে লাশ এ পুকুরে বা এর আশপাশে ফেলে যেতে পারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close