নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২২ জুন, ২০১৮

আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পেছনে রাষ্ট্রের যত খরচ

* সমপরিমাণ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ৩৯৭ কোটি ১৮ লাখ ৩৭ হাজার ৩৯৩ টাকা * কক্সবাজারের পাঁচ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি উজাড়

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার কারণে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের বিভিন্ন খাতে ব্যয় বেড়েছে। অর্থনৈতিক খরচের পাশাপাশি বেড়েছে অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষাসহ সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার ব্যয়। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের প্রশাসনিক খরচও বেড়েছে। এতে অর্থনীতিতে বাড়তি চাপে পড়ছে বাংলাদেশ। সরেজমিন অনুসন্ধান ও বিষেজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় এক লাখ ৬৫ হাজার আশ্রয় ক্যাম্প। পাহাড় ও বন কেটে স্থাপন করা হয়েছে অবকাঠামো। এ কারণে উজাড় হয়েছে কক্সবাজারের প্রায় পাঁচ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি। এতে ৩৯৭ কোটি ১৮ লাখ ৩৭ হাজার ৩৯৩ টাকার সম পরিমাণ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ব্যয় নেই। তাদের ব্যয় তা বিভিন্ন দেশ, দাতা গোষ্ঠী, দাতা সংস্থা, জাতিসংঘ ও ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে পাওয়া ত্রাণের ওপরই চলছে। এ সব ত্রাণসামগ্রী সরকারের ত্রাণ মন্ত্রণালয় বা সকারের ত্রাণ ভা-ারেও জমা হয় না। এসব জমা করার জন্য জেলা প্রশাসকের ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে কক্সবাজারে স্থাপিত হয়েছে বিশেষ গুদাম। এগুলো বিতরণ ও তদারকি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রোহিঙ্গাদের জন্য ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জন্য স্থায়ী আবাসন গড়তে নোয়াখালীর ভাসানচরে আবাসন নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেছে একনেক। এ প্রকল্পের আওতায় ভাসানচরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামে এক হাজার ৪৪০টি ব্যারাক ও ১২০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এতে মোট ব্যয় হবে দুই হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ব্যয় প্রায় ৭০০ ডলার কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যয় থাকলেও বৈধপথে আয়ের কোনো উৎস নেই। সেই হিসাবে এই ১০ লাখ রোহিঙ্গার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হতে পারে কমপক্ষে প্রায় ৬০ কোটি ডলার। এটি অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা।

এ প্রসঙ্গে ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা, তাদের আশ্রয় দেওয়া, খাদ্য নিশ্চিত করার ব্যয় বাড়বে। এসব বিষয় নিশ্চিত করতে গিয়ে বৈদেশিক সাহায্য কতটা পাওয়া যায়, সেটাই দেখার বিষয়। পাওয়া গেলে ভালো। না পেলে তা বাংলাদেশকেই জোগান দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে পর্যটন খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাড়বে পর্যটন ব্যবস্থা উন্নয়ন ব্যয়। সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে এবং পরিবেশ দূষিত হলে পর্যটকের সংখ্যা অনেক কমে যাবে। এর প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই।’

এদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) মনে করে, রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ বড় ধরনের আর্থিক চাপে পড়তে পারে। তাদের পেছনে বাড়তি মনোযোগ দিতে সেখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন নিয়োগ করতে হয়েছে। এই ব্যয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাজেট থেকে। এই খরচ অন্য জায়গায় করা যেতো বলে মনে করেন বিআইডিএসের সিনিয়র গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ।

জাতিসংঘের অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থান করছে। তাদের জন্য আশ্রয়শিবির স্থাপনে সরকার বেছে নিয়েছে টেকনাফ অভয়ারণ্য সংলগ্ন রিজার্ভ বনাঞ্চলের অংশবিশেষ। এরই মধ্যে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় চার হাজার একর পাহাড় ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ীভাবে আশ্রয় শিবির স্থাপনে টেকনাফ উপজেলার কুতুপালং ও বালুখালীতে অবস্থিত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আরো প্রায় আড়াই হাজার একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, বন আইন ১৯২৭-এর আওতায় ১৯৩১ সালে ৩০ হাজার একর আয়তনের এ বনকে রিজার্ভ বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যার অবস্থান টেকনাফ অভয়ারণ্যের দুই কিলোমিটারের মধ্যে। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এর ৪/১৪ (ক) তে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনো প্রকার অবকাঠামো বা স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। রিজার্ভ বনাঞ্চলের অংশবিশেষে আশ্রয়শিবির স্থাপনে বাংলাদেশ বন বিভাগের লিখিত আপত্তিকেও উপেক্ষা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ অন্যান্য কাজে লোকবল নিয়োজিত করতে হবে। এর জন্য বাড়বে প্রশাসনিক ব্যয়।’ অর্থনীতিবীদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে বছরে গড়ে এক হাজার কোটি ডলারের অধিক ক্ষতি হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে দেশের ভূমি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দ্রব্যমূল্যের গতি প্রকৃতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হুমকির মুখে পড়ছে। এসব হুমকি কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণে ব্যয়। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১১টি স্থানে পাহাড় ও বনভূমি উজাড় করে তাদের ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছে। এজন্য দুই দফায় মোট চার হাজার ৮৫১ একর বনভূমি নেওয়া হয়েছে।’

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সংরক্ষিত বনভূমির মধ্যে রয়েছে কুতুপালংয়ের এক হাজার ১২১ কোটি ৩৩ লাখ ৭৩ হাজার ১৩৬ টাকা মূল্যের ৪০১ দশমিক ৪০ একর, জামতলী ও বাঘঘোনার ৫৩ কোটি ৪২ লাখ ৫১ হাজার ৪০৮ টাকার ৫১৬ একর, বালুখালীর ৯৫ কোটি চার লাখ ৫৩ হাজার ৭৯০ টাকার ৮৩৯ একর, তাজনিমা খোলার ৪১ কোটি ৯০ লাখ ৮০ হাজার ৬৮২ টাকার ৪৫১ একর, উখিয়ার বালুখালী ঢালা ও ময়নারঘোনার ২৭ কোটি এক লাখ ৪৩ হাজার ৮৬৬ টাকার ৩১০ একর, শফিউল্লাহ কাটা এলাকার ১৮ কোটি ৮৬ লাখ ৭৪ হাজার ৩৮১ টাকার ২০১ দশমিক ২০ একর, নয়াপাড়ার ২২ কোটি আট লাখ ১৫ হাজার ৪৮০ টাকার ২২৪ একর, টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের পুঁটিবুনিয়ার সাত কোটি ৫৩ লাখ ৯৯ হাজার ৭৩২ টাকার ৮৮ দশমিক ৬০ একর, কেরনতলী ও চাকমারকুল এলাকার ৪৯ হাজার ৩৪৪ টাকার ৭৯ দশমিক ৮০ একর এবং লেদারের তিন কোটি ৮২ লাখ ৯৫ হাজার ৫৭৪ টাকার ৪৫ একর সংরক্ষিত বনভূমি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, ড. এ এইচ এম রায়হান সরকার বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরে রান্নার কাজে দৈনিক ৫০০ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। যার বেশিরভাগই আসছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে। গৃহনির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ব্যাপকভাবে বাঁশ ও উলুখড় স্থানীয় বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে বন্য হাতি হারিয়ে যেতে পারে। জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যেতে পারে।’

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বনমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে দাবি করা হয়, রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের কারণে এখন পর্যন্ত ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন টাকা সম মূল্যের বনজ সম্পদ ব্যয় করা হয়েছে। পুরো বিষয়টি আমলে নিলে এ ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০ হাজার কোটি টাকার উপরে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist