প্রিন্স রাসেল, দুবাই থেকে

  ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

দুবাইতে স্বপ্নভঙ্গের চেনা ছবি

শুরু আর শেষটায় কত অমিল। উড়ন্ত একটা সূচনা। অতঃপর ব্যাটিং ধস। ৩০০ এর আশা জাগানো বাংলাদেশ দল গুটিয়ে গেল ২২২ রানে। ভারতের গভীর ব্যাটিং লাইনের জন্য লক্ষ্যটা সহজ। কিন্তু সেটাকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলেছিলেন রুবেল-মুস্তাফিজ-মাশরাফিরা। স্বল্প পুঁজি নিয়ে ভারতের বিপক্ষে বোলিংয়ের সর্বোচ্চ শক্তিটাই খরচ করেছে টাইগাররা। তাতে রীতিমতো কেঁপে উঠেছিলেন রোহিত-ধোনি-জাদেজারা। এমন প্রবল চাপের মুখ থেকেই ম্যাচটা বের করে নিল ভারত। শেষ বলে স্বপ্নভঙ্গের চেনা ছবি। ঢাকা, কলম্বোর মতো দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামেও শিরোপা হাত ছোঁয়া দূরত্বে রেখে এলেন মাশরাফিরা।

আসলে বাংলাদেশের ভাগ্যে ট্রফি নেই। না হলে এভাবে কেনই বা শিরোপার চারপাশ দিয়ে বার বার হেঁটে যেতে হবে। বহুজাতিক কোনো টুর্নামেন্টে শ্রেষ্ঠত্বের স্বপ্নটা তাই অধরা হয়ে থাকল। এত কাছে তবু কত দূর। যেন আলোকবর্ষ দূরে। দূরত্বটা ঘোচানোর প্রবল সম্ভাবনা জাগিয়েও দুঃস্বপ্নে মোড়ানো থাকল শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচগুলো। ফাইনালটা বাংলাদেশের জন্য অভিশাপের এক মঞ্চ হয়ে থাকল। এতবার ফাইনাল খেলেও টুর্নামেন্ট জিততে না পারার যন্ত্রণাটা ক্রিকেট মানচিত্রে শুধু একটা দলেরই।

কাল দুবাইয়ের মহানাটকীয় ফাইনালে উত্তেজনার রেণু ছড়াল মুহূর্তে মুহূর্তে। রঙ ছড়ানো ম্যাচের শেষ ওভার হলো স্নায়ুচাপের। স্টেডিয়ামে ২৫ হাজার দর্শক- শিহরণ জাগেনি কার? পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের শেষ ওভারের কঠিন সমীকরণটা গেল ভারতের পক্ষেই। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আগলে রাখতে পারেননি ৬ রানের পুঁজিটা।

অথচ সংগ্রহটা আগলে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টাই করে গেছেন পেসাররা। ইনিংসের আগা-গোড়া ভারতকে কোণঠাসা করে রেখেছিল বাংলাদেশ। যাকে জয়ের পথে সবচেয়ে বড় কাঁটা মনে করা হচ্ছিল সেই মহেন্দ্র সিং ধোনিকে সাজঘরে পাঠিয়ে ম্যাচের রোমাঞ্চ তুঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। ৩৬ রানে ধোনি সাজঘরে ফেরার পরও ম্যাচের লাগাম হাতে রাখতে পারেনি টাইগাররা।

ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানো ম্যাচটা যে থ্রিলার উপহার দিতে চলেছে সেটার আভাস মিলেছিল ভারতের ইনিংসের শুরুর দিকেই। ৩৫ রানে ভারতের উদ্বোধনী জুটি বিচ্ছিন্ন করে আশার প্রদীপটা জ্বেলেছিলেন নাজমুল ইসলাম অপু। ১৪ বলে ১৫ রানে করে ফেরেন টুর্নামেন্টজুড়ে ধারবাহিক থাকা শিখর ধাওয়ান। ১১ রানের ব্যবধানে ভারতের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে আম্বাতি রাইডুকে সাজঘরে পাঠান মাশরাফি বিন মর্তুজা। রাউডুকে মুশফিকুর রহিমের গ্লাভসে ক্যাচ বানান ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’।

ভারতের ইনিংসের শুরুতেই জমে ওঠা ম্যাচে বাধা মনে করে হচ্ছিল অধিনায়ক রোহিত শর্মাকে। দলকে নির্ভার করতে স্বভাবসুলভ ব্যাটিংটাই করলেন ডানহাতি এই ওপেনার। ৪৮ রানে তাকে বলবন্দি করেন রুবেল হোসেন। ৩টি চার ও ৩টি ছক্কা হাঁকানো রোহিতকে মহাচাপেই ফেলে দিয়েছিলেন টাইগার পেসার। ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল তাতেই। রুবেলের শট বাউন্সারটাকে সীমানাদড়ি ছাড়া করতে গিয়ে রোহিত ক্যাচ তুলে দিলেন নাজমুলের হাতে।

৮৩ রানে ৩ উইকেটের পতন। রোহিতের বিদায়ে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলেছিল বাংলাদেশ। সেটাকে পরে দীর্ঘশ্বাসে রূপান্তর করার জন্য উইকেটে জমে ওঠেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। ‘ক্যাপ্টেন কুলে’র সঙ্গে দিনেশ কার্তিকের চতুর্থ উইকেট জুটিটা ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। নিদাহাস ট্রফির স্বপ্নভঙ্গের ঘাতক কার্তিককে ফিরিয়ে ৫৪ রানের জুটি ভেঙে দারুণভাবেই ম্যাচে ফিরে আসে টাইগাররা।

সর্বকালের সেরা ফিনিশার খ্যাত ধোনির বিদায়ঘণ্টা বাজল একটু পরই। কিন্তু নির্ভার হওয়া গেল না। পায়ের ইনজুরি নিয়ে স্কচটেপ প্যাচিয়ে উইকেট ছেড়ে যাওয়া কেদার যাদব যে আবারও ফিরে এসেছেন! কিন্তু তার প্রস্থান আর ঘটাতে পারলেন না বাংলাদেশের বোলাররা। ভারতকে চ্যাম্পিয়ন করেই উইকেট ছেড়েছেন তিনি। ২৩ রানে শেষ অবধি অজেয় থাকলেন যাদব। তাকে নায়কের ভূমিকায় আনতে জয়ের পথটা কিছুটা হলেও মসৃণ করে দিয়ে গেছেন রবিন্দ্র জাদেজা (২৩) এবং ভুবনেশ্বর কুমার (২১)। এ যুগলের ক্যামিও ইনিংস বাংলাদেশের আশার সমাধি ঘটাতে হয়ে উঠল কার্যকর।

এদিন বল মাঠে গড়ানোর আগেই একবার হেরে বসেছে বাংলাদেশ। মুদ্রা নিক্ষেপের সুবিধা অনুকূলে নিয়ে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায় ভারত। উদ্বোধনী জুটিতে লিটন দাশ এমন একজনকেই সঙ্গী হিসেবে পেলেন যিনি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে কখনোই ওপেনিং করেননি। সৌম্য সরকার কিংবা ইমরুল কায়েস নয়, মহাবিস্ময় হিসেবে লিটন সঙ্গী হিসেবে দুবাইয়ের বাইশ গজে নেমে পড়লেন মেহেদি হাসান মিরাজ!

ইনজুরি নিয়ে দেশে ফিরে গেছেন তামিম ইকবাল এবং সাকিব আল হাসান। তাদের অনুপস্থিতিতে অলিখিত সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে ৩৭ রানে স্বপ্নপূরণের মঞ্চের টিকিট কেটেছিল বাংলাদেশ। দলের অন্যতম সেরা দুই তারকার অভাবটা বুঝতেই দেননি মাশরাফি, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম। অথচ কাল মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নিষ্প্রভ থাকলেন তিনজনই।

ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সংগীত পড়তে যখন বাংলাদেশ দল মাঠে ঢুকেছিল তখনই বিস্ময়ে সবার চোখ উঠে গেছে কপালে। ইমরুল, লিটনের সঙ্গে গার্ড-প্যাড পড়ে সবুজ ময়দানে নেমে পড়লেন মিরাজও। অনুমানটাই পরে সত্যি হলো। টপ অর্ডারের উইকেটের লাগাম টেনে ধরতে ওপেনিংয়ে ব্যাট হাতে হাজির হলেন মিরাজ। শুরুতে ওপেনারদের কিছুটা নড়বড়ে দেখালেও দ্রুতই তা সামলে নিয়েছেন মিরাজ-লিটন।

ভারতের বোলিংয়ের বিপরীতে আক্রমণাত্মক শুরু করে এই জুটি। উইকেটের সামনে দাঁড়িয়ে বুমরাহ-ভুবনেশ্বরদের পিটিয়ে তুলোধুনা করেছেন লিটন। ভারতীয় বোলারদের বিপরীতে তার ব্যাট হয়ে ওঠে তরবারি। তা দিয়েই কচুকাটা করলেন ডান-হাতি ব্যাটসম্যান। মিরাজ শুধু উইকেট আগলে রেখে তাকে যোগ্য সঙ্গটাই দিয়েছেন।

বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাত তুলেছেন দুজন মিলে। উদ্বোধনী জুটিতে দুজন মিলে করেছেন ১২০ রান। জুটি ভাঙে ৩২ রানে মিরাজের বিদায়ে। টাইগার অলরাউন্ডারের সাজঘরে ফেরাটাই কাল হয়ে দাঁড়াল। আচমকা বিপর্যয় নেমে আসে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে। টুর্নামেন্টজুড়ে আলো ছড়ানো মিডল অর্ডার ধসে পড়ল কয়েক মিনিটের মধ্যে।

বিনা উইকেটে ১২০ থাকা বাংলাদেশ হঠাৎই হয়ে গেল ৪ উইকেটে ১৩৯। এই সময়ে সাজঘরে ফিরে গেছেন ইমরুল কায়েস, মুশফিকুর রহিম এবং মোহাম্মদ মিঠুন। একটু পর বিদায় নিলেন পাকিস্তান ম্যাচের নায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও। প্রতেকের আউটই ছিল দৃষ্টিকটু। রান আউটের ফাঁদে পা দিয়েছেন মিঠুন। শুধু তিনিই নন, সৌম্য, নাজমুল ইসলামকেও বরণ করতে হয়েছে একই ভাগ্য। এক ইনিংসে তিনটি রান আউট! এর মধ্যে দুটিই হয়েছে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিতে। প্রায় অবিশ্বাস্য শুরুর পরও ব্যাটসমানরা যেভাবে সাজঘরের পথ খুঁজে নিয়েছেন সেটা অবাক হওয়ার মতোই।

দলের আটজন ব্যাটসম্যান দুই অঙ্কেই যেতে পারেননি। চতুর্থ সর্বোচ্চ সমান ৭ রান করে করেছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা ও নাজমুল। আত্মহত্যা করেছেন প্রথমজনও। কঠিন চাপের মুখে ছক্কা মারার বিলাসিতা করতে গিয়ে স্টাম্পিং হয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। কেদার যাদবের বলে একই ভুলটা একটু আগে করে গেছেন ক্যারিয়ার সেরা ১২১ রানের ইনিংস খেলা লিটন। ৫২ রানে এই যাদবের বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। লিটনের ক্যাচ চাহালের হাত ফসকে বেরিয়ে যায়।

টাইগার ওপেনারের আউটটাকে অবশ্য দুর্ভাগ্য হিসেবে নেওয়া যায়। তার আউটটা নিয়ে অবশ্য বেশ কিছুক্ষণ নিরীক্ষা চালাতে হয়েছে টিভি আম্পায়ারদের। অতিআবেগী টাইগার ভক্তদের কাছে লিটনের আউটটা মেনে নেওয়াও ছিল কষ্টসাধ্য। লিটানের আউট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বয়ে গেল বিতর্কের ঝড়। রান আউট আর স্টাম্পিংয়ে বাংলাদেশ যে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সেটা অনেকটা আড়ালে চলে গেল এই বিতর্কে।

ভাগ্য সবসময় সাহীসের পক্ষেই থাকে। শুরুতে তাই ছিল। কিন্তু এরপরই পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। এই টুর্নামেন্টে আগের ৫ ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা যেখানে আলো ছড়িয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়েছেন ব্যাট থেকে। এমন ম্যাচে ব্যর্থতার বৃত্ত ভেঙেছেন লিটন, টানা দুই ম্যাচে সুযোগ পাওয়া সৌম্য। শেষ ওভারটা তো সৌম্যরই করার কথা ছিল। কিন্তু শেষটায় আর চমক থাকল না। উপায় না পেয়ে শেষ ওভারে পার্ট টাইম স্পিনার মাহমুদউল্লাহর হাতে বল তুলে দেন মাশরাফি। কিন্তু বিপিএলে কয়েকটা ম্যাচে রূপকথার সমাপ্তি টানলেও কাল ভারতের বিপক্ষে পারলেন না তিনি। পারবেন কীভাবে শিরোপা যে বাংলাদেশের ভাগ্যে নেই। ভাগ্যদেবী ষষ্ঠবারও মুখ তুলে তাকাল না। তাই আরেকটি ফাইনাল হারের শোক নিয়ে ঘরে ফিরতে হচ্ছে মাশরাফিদের।

কয়েক মাস আগে এই ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এশিয়া কাপে। সালমাদের পদাঙ্ক অনুকরণ করা হলো না মাশরাফিদের। ফাইনালটা তাদের কাছে একটা জুজু হয়েই থাকল।

বাংলাদেশ ২২২/১০

ভারত ২২৩/৭

ভারত ৩ উইকেটে জয়ী

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দুবাই,স্বপ্ন ভঙ্গ,চেনা ছবি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close