বিশেষ প্রতিনিধি

  ০৪ মে, ২০১৭

সিটিং সার্ভিস নিয়ে আরেক দফা পিছু হটলো সরকার

রাজধানী ও এর আশপাশের গণপরিবহনের অবৈধ সিটিং সার্ভিস বন্ধে আবার পিছু হটল সরকার। গত মাসে চার দিন সিটিং সার্ভিস বন্ধ থাকার পর গণপরিবহনের নৈরাজ্য আরো প্রকট হলে বাধ্য হয়ে সরকার ১৫ দিনের জন্য সে সিদ্ধান্ত স্থগিত করে। সে সময় বলা হয়, ১৫ দিন পর, অর্থাৎ আজ সরকারের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে সিটিং সার্ভিসের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এর দুই দিন আগেই গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় বাস-মিনিবাসের সিটিং সার্ভিস চালু রাখার সময়সীমা আরো তিন মাস বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়।

এর ফলে সিটিং সার্ভিস থাকবে কি না-সে সিদ্ধান্ত আরো তিন মাসের জন্য ঝুলে গেল। অমীমাংসিত থেকে গেল ভাড়া নিয়ে গণপরিবহনের নৈরাজ্য সমাধানের বিষয়টিও। বিশেষ করে সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত হওয়ার পর বিআরটিএ ঘোষণা দিয়েছিল এখন থেকে সব ধরনের গণপরিবহনে বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া আদায় করতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বাস কর্তৃপক্ষকেই সে নির্দেশ মানতে দেখা যায়নি। উল্টো সরকারের এ সিদ্ধান্তহীনতার সুযোগে রাজধানী ও এর আশপাশের অধিকাংশ গণপরিবহন নতুন করে সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিতের পাশাপাশি ভাড়া নৈরাজ্যসহ বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা দূর করতে চালানো ভ্রাম্যমাণ আদালত তুলে নেওয়ায় ভাড়া নৈরাজ্য আরো বেড়েছে।

সিটিং সার্ভিস চালু রাখার সময়সীমা আরো তিন মাস বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্তকে গণপরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের কাছে ‘সরকারের নতজানু মনোভাব’ ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকার ‘ব্যর্থ’ বলে মন্তব্য করেছেন পরিবহন ও যাত্রী অধিকার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকারের সদিচ্ছার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা আলাদা করে সিটিং সার্ভিস চালুর দরকার নেই বলে অভিমত জানিয়েছেন। তাদের মতে, গণপরিবহনের জন্য বিআরটিএ যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, সে ভাড়াতেই যাত্রীদের সমস্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে। সেখানে অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে সিটিং সার্ভিস চালুর প্রশ্নই আসে না। এমনকি মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী ‘সিটিং সার্ভিস’ অবৈধ। সরকার যদি এটি চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় সে ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় নেওয়ার আবার ঘোষণা দিয়েছেন যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কর্মরত সংস্থাগুলো।

তবে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ‘ব্যর্থতা’ বলতে নারাজ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গতকাল তিনি বলেন, ‘সিটিং সার্ভিস নিয়ে একটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত সমাধান খোঁজা হচ্ছে। আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখছি, স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে কথা হচ্ছে, কোনো ধরনের চাপের কাছে নতি স্বীকার নয়, সাংবাদিক প্রতিনিধিও আলোচনার এ কমিটিতে রয়েছে, সাংবাদিকের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন স্থগিত রেখে একটি বিষদ আলোচনা করে একটি যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত সমাধান যাতে হয় সে ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছি।’

সিটিং সার্ভিস অবৈধ আখ্যা দিয়ে গত ১৫ এপ্রিল থেকে তা বন্ধের ঘোষণা দেয় পরিবহন মালিকদের সংগঠন ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি। ১৬ এপ্রিল থেকে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। এরপর ঢাকায় প্রায় ৪০ শতাংশ বাস-মিনিবাস চলাচল বন্ধ করে দেন মালিক-শ্রমিকেরা। টানা পাঁচ দিন ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, বাস-মিনিবাস-সংকটে জনদুর্ভোগ এবং বাড়তি ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। সিটিং সার্ভিস বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের সময় (১৬ থেকে ২০ এপ্রিল) সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ পর্যাপ্ত বাস-মিনিবাস নামাতে পারেনি। আবার সরকার নির্ধারিত ভাড়াও নিশ্চিত করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে ২০ এপ্রিল মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করে সিটিং সার্ভিস বন্ধের অভিযান ১৫ দিনের জন্য স্থগিত করে বিআরটিএ। সে সময় সংস্থাটির চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেছিলেন, সিটিং সার্ভিস চললেও সরকার নির্ধারিত ভাড়াই মেনে চলবেন মালিক-শ্রমিকরা। এটা নিশ্চিত করার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু সেসবের কিছুই মানেননি বাস মালিক-শ্রমিকরা। বরং সিটিং সার্ভিসের নামে আরো বেড়েছে ভাড়া নৈরাজ্য।

বিআরটিএ চেয়ারম্যানের ঘোষণা অনুযায়ী সিটিং সার্ভিসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আজ বৈঠক করার কথা বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ এ বৈঠকের ব্যাপারে কিছু জানাননি। বারবার চেষ্টা করেও বিআরটিএ চেয়ারম্যান ও মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তাদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। এমনকি এ ব্যাপারে কিছুই জানাতে পারেননি সিটিং সার্ভিস বন্ধের মূল উদ্যোক্তা ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘সিটিং সার্ভিসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বিআরটিএ একটি কমিটি করেছে। ওই কমিটি যদি আমাদের চিঠি দেয়, আমরা বসব। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি পাইনি। কথা ছিল স্থগিতের ১৫ দিন পর বৈঠকে বসার। কিন্তু সে ব্যাপারেও বিআরটিএ কিছু জানায়নি।’

ঢাকায় সিটিং সার্ভিস চলবে কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গতকাল আট সদস্যের একটি কমিটি করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুবে রব্বানীকে প্রধান করে এই কমিটি করা হয়েছে বলে তিনি জানান। কমিটির মেয়াদ তিন মাস। এ সময়ের মধ্যে কমিটি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় সিটিং সার্ভিসের প্রয়োজন আছে কিনা তা জানবে। এরপর তাদের মতামত দেবে। কমিটির দেওয়া মতামতের ভিত্তিতে বিআরটিএ-পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে বলে জানান মাহবুবে রব্বানী। কমিটিতে মালিক সমিতি ও শ্রমিক সমিতির একজন করে প্রতিনিধি ছাড়াও বিআরটিএর ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক, সাংবাদিক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে।

সরকারের এ কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সিটিং সার্ভিসের ব্যাপারে সরকার ১৫ দিন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। এখন আবার তিন মাস ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। তার মানে সিটিং সার্ভিসের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। এটি সরকারের ব্যর্থতা।

এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, যাদের বিরুদ্ধে গণপরিবহন খাতে নৈরাজ্যের অভিযোগ, ‘সেই শ্রমিক-মালিক নিয়েই কমিটি করা হয়েছে। সেখানে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে কাউকে রাখা হয়নি। এই কমিটি ভাড়া নৈরাজ্যে জনস্বার্থের জন্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। সরকার যখনই জনস্বার্থের জন্য কাজ করতে যায় তখনই মালিকপক্ষদের চাপে তা বন্ধ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে সিটিং বন্ধ করা সরকারের একটি কঠিন চ্যালেঞ্জে। সিটিং সার্ভিস বন্ধের জন্য আমরা অনেক আগ থেকেই বিআরটিএকে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ দিয়েছে, এর পরও তারা আমাদের এ কমিটিতে রাখেননি। যাত্রীদের কথা চিন্তা করে আমরা শিগগিরই একটি নাগরিক সমাজ কমিটি গড়ে তুলব। সেই কমিটি যাত্রী দুর্ভোগ নিয়ে গণশুনানি করবে এবং সরকারের কাছে তুলে ধরবে।’

একইভাবে নিরাপদ সড়ক চাইয়ের সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘সিদ্ধান্তই হয়, বাস্তবায়ন নেই। আমরা প্রথম থেকেই ভয় পাচ্ছিলাম সিটিং সার্ভিসের ব্যাপারে সরকার পিছু হটে কিনা। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। কিছুতেই গণপরিবহনকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পারছে না। সরকারকে সিটিং সার্ভিসসহ গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে হলে সরকারকে অবশ্যই সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসিকে সচল করতে হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা কারসাজি করে বিআরটিসিকে অকেজো করে রেখেছে। সেখানে চালক ও চালক সহকারীর সংকট রয়েছে। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ বাসগুলো ভাড়া দিয়ে দিচ্ছে। গণপরিবহনে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু করলে হবে না। সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহন খাতে কিছুতেই শৃঙ্খলা আনা যাচ্ছে না। নানা সিদ্ধান্ত হচ্ছে। বাস্তবায়নে উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই বেকে বসছেন বাস মালিক-শ্রমিক নেতারা। ধর্মঘটের নামে অচল করে দেওয়া হচ্ছে দেশ। দুর্ভোগে ফেলা হচ্ছে যাত্রীদের। শেষপর্যন্ত নিরুপায় হয়ে বারবার পিছু হটতে হচ্ছে সরকারকে। দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে গণপরিবহনে অবৈধভাবে সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে বাস ও মিনিবাসগুলো। মানা হচ্ছে না মোটরযান আইনের কিছুই। সর্বশেষ সিটিং সার্ভিস বন্ধের ব্যাপারে দুদফা ব্যর্থ হলো সরকার। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে এক বাসচালককে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং সড়ক দুর্ঘটনা মামলায় এক ট্রাকচালকের মৃত্যুদ-ের রায়ের প্রতিবাদে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকা ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়ে দেশের পরিবহনব্যবস্থা। তখনো শেষপর্যন্ত বাসমালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় যেতে বাধ্য হয় সরকার। এমনকি পাস হতে যাওয়া পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতেও সরকারকে এক ধরনের চাপের মুখে রেখেছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা।

কেন পরিবহন খাতে এমন ঘটনা বারবার ঘটছে? এর নেপথ্যেইবা কারা? জানতে চাইলে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৯০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত পরিবহন খাত ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দখলে। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন নিয়ন্ত্রণ করছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি এই ফেডারেশনের কার্যকারী সভাপতি। অন্যদিকে মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী ও সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা ও মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। এনায়েত উল্যাহ ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকও বটে। বিএনপির সময়ে পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করতেন মির্জা আব্বাস।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist