কাইয়ুম আহমেদ

  ০১ ডিসেম্বর, ২০১৯

সড়কের শৃঙ্খলা অধরা, বৈধ চালকের সংকট

দেশে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪২ লাখের মতো। কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক গাড়ি চালানোর জন্য লাইসেন্সধারী বা বৈধ চালকের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। এছাড়া মাত্র ১৩৯টি বৈধ স্কুলে চলছে সারা দেশের চালক প্রশিক্ষণ। এই বিপুলসংখ্যক গাড়ি ও বৈধ চালকের অসামঞ্জস্য পরিস্থিতির মধ্যেই সীমিত পরিসরে এই আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে হিমশিম হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। এই অবস্থায় নতুন আইন প্রয়োগ করে সড়কে যানবাহন চলাচলের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা অধরাই থাকছে।

সূত্র জানায়, পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বিআরটিএর কর্মকর্তাদের বক্তব্যে দেশে মধ্যম ও ভারি—দুই শ্রেণির মোটরযানের ক্ষেত্রেই চালক সঙ্কটের কথা বারবার উঠে এসেছে। এমনকি খোদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা অর্ধেক। এমনকি পরিবহন মালিক সংগঠনগুলোর কাছ থেকেও দক্ষ বা বৈধ চালক সঙ্কটের বিষয়টি উঠে এসেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা অবৈধ ড্রাইভিং স্কুলের বেশির ভাগেরই প্রশিক্ষণের জন্য ক্লাসরুম তো দূরের কথা, নেই কোনো অফিস কক্ষ। গাড়ির ভেতরে আসবাবপত্র নিয়ে চলছে কয়েকটি অবৈধ ড্রাইভিং স্কুলের কার্যক্রম।

অবৈধ স্কুল মালিকরা বলেন, বৈধ স্কুলের জন্য প্রয়োজনীয় মাঠ, ক্লাসরুম, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ও ট্রেড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণে জটিলতা থাকায় অবৈধভাবেই কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা। অবৈধ স্কুলগুলো মানসম্মত করার মাধ্যমে এবং অপ্রয়োজনীয় শর্ত শিথিল করে বৈধতা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

ড্রাইভার্স ট্রেনিং সেন্টারের চেয়ারম্যান নুর নবী শিমু বলেন, একটা ডকুমেন্টের জন্য এখানে এবং বিআরটিএতে যেতে হয়। আমার মনে হয় এ প্রক্রিয়াটা একটু শিথিল করে লাইসেন্স দেওয়া উচিত।

দেখা যায়, রাস্তায় অনেক গাড়িই চালাচ্ছে হেলপাররা। যাদের বেশির ভাগের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। অথচ আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে একজন পেশাদার চালকের বয়স হতে হয় কমপক্ষে ২০ বছর। যার কোনোটি না থাকা সত্ত্বেও গাড়িভর্তি যাত্রী নিয়ে চলছে এসব কিশোর চালক। এরা জানিয়েছে, পুলিশকে টাকা দিলেই বিনা বাধায় তারা সড়কে গাড়ি চালাতে পারে। দূরপাল্লার গাড়িগুলোর ১ শতাংশ বিআরটিসি নিয়ন্ত্রণ করে। বাকি ৯৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি মালিকপক্ষ।

বিআরটিএর বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পরীক্ষার পর চালককে প্রথমে হালকা মোটরযানের (আড়াই হাজার কেজির কম ওজন) পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া হয়। তিন বছর হালকা মোটরযান চালানোর পর একজন চালক মধ্যম শ্রেণির মোটরযান (আড়াই থেকে সাড়ে ৬ হাজার কেজি) চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেন। একইভাবে তিন বছর মধ্যম মোটরযান চালানোর পর চালককে ভারি মোটরযান (সাড়ে ৬ হাজার কেজির বেশি) চালানোর জন্য পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া হয়। বাস-ট্রাক চালাতে প্রয়োজন পড়ে ভারি শ্রেণির মোটরযান চালানোর লাইসেন্স।

দক্ষ চালক গড়ে তোলার মতো গুরুত্বপূর্ণ এ কাজে বিআরটিএ ও বিআরটিসি ছাড়াও আরো বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বুয়েটের এআরআইর সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ড্রাইভিং স্কুল থেকে এসে যাতে সবাই পরীক্ষা দেয় সেটা বাধ্যতামূলক করা উচিত। এ স্কুলগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান জানান, ১ নভেম্বর থেকে আইনটি কার্যকর হয়েছে। তবে শুরুতে আইন প্রয়োগের বদলে আইনটি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আর সীমিত পরিসরে আইনটির প্রয়োগ শুরু হলেও আপাতত সচেতনতামূলক কার্যক্রমেই বেশি জোর দেওয়া হবে।

দক্ষ চালক তৈরির বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী জানান, ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে সারা দেশে ৬ লাখ ভারি চালক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে এ চালকদের তৈরি করে নেওয়া হবে। এর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে দক্ষ চালক তৈরিতে বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বাস্তবে বৈধ-অবৈধ গাড়ি মিলিয়ে সারা দেশে ৪০ লাখের বেশি গাড়ির পেছনে নিয়মিত অনিয়মিত মিলিয়ে চালক রয়েছে ৭০ লাখ। তাদের মধ্যে বিআরটিএ এর লাইসেন্স আছে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ। বাকিরা অবৈধভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ও অননুমোদিত বাস, লেগুনা, নসিমন-করিমন ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসহ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি গাড়ি সারা দেশে যাত্রী পরিবহন করছে। এসব চালকের কোনো লাইসেন্স নেই।

চালক সঙ্কটের বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জানান, দেশে বাস-ট্রাকের ড্রাইভার সঙ্কট দুই লাখের মতো। বিষয়টি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবকে অবহিত করে ড্রাইভিং স্কুল প্রতিষ্ঠার আবেদন করা হয়েছিল। ওই পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ঢাকার পূর্বাচল এলাকায় ড্রাইভিং স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) অনুকূলে কিছু জমি বরাদ্দ দেয়া হবে। জমি পাওয়া গেলে ডিটিসিএর সঙ্গে সমঝোতা বা চুক্তি করে সেখানে মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ড্রাইভিং স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিআরটিএ,ড্রাইভিং,লাইসেন্স,চালক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close