রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১১ নভেম্বর, ২০১৯

প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে

শিশুদের দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষা। সেখান থেকেই শিশুরা জানতে পারে দেশ ও সমাজ সম্পর্কে। সেই সঙ্গে তার সুকুমারবৃত্তি চর্চারও প্রাথমিক পর্যায় এটি। সেখানেই শিক্ষার্থীদের উৎকর্ষ সাধনে নেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। শিশুকাল থেকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ না হওয়া এবং সাংস্কৃতিক চর্চা না থাকায় তারা হাঁটছে বিপথে এমনটাই মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।

গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলার সঙ্গে শিক্ষার্থীরা জড়িত। দেশের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ২৩ শতাংশেই গাওয়া হয় না জাতীয় সংগীত। সেইসঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না ৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। ৮৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই গ্রন্থাগার এবং ৪৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজন করা হয় না বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার। ৪১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে হয় না বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং স্কাউটিং হয় না ৭০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সারা দেশে জরিপের ভিত্তিতে গণসাক্ষরতা অভিযানের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট ২০১৫ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশ করা হয়। সারা দেশের প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

এডিপির প্রকল্পগুলো নেওয়া হয় যাদের জরিপ-শুমারির তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে, সেই বিবিএসে কাজের নামে চলছে দুর্নীতি-গাফিলতি। এসব জরিপের তথ্য থেকে দেখা যায় গত ১০ বছরে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার অর্ধেকের বেশি কমেছে। কিন্তু সরকার ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চান। এক সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা ছিলেন সমাজের সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি। সেই অবস্থা এখন আর নেই। অধিকাংশ শিক্ষক বিদ্যালয়ে আসা যাওয়াকে কর্তব্য মনে করেন। বেলা ১১টায় এসে দুপুর ১টার মধ্যে চলে যান। বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সস্কার কাজ, বিদ্যালয়ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (স্লিপ), রুটিন মেইনটেন্যান্স, প্রাক প্রাথমিকের ক্লাস সজ্জিতকরণ, ওয়াশব্লক, রক্ষণাবেক্ষণ, বই বিতরণ, শোক দিবস পালন, বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানসহ আনুষঙ্গিক খ্যাতে প্রতি বছর অর্থ বরাদ্দ হয়। শুধু স্লিপের জন্য শিক্ষার্থীভেদে বছরে প্রতি স্কুলে ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে এসব অর্থ আত্মসাতের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। প্রধান শিক্ষক, স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা এসব ঘটনায় জড়িত। বিবেক-জ্ঞান-বুদ্ধি ও মনুষ্যত্বের কারণে মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব বলা হয়। সততা-নীতি-নৈতিকতা, দেশপ্রেম, পরোপকার এবং আদর্শ চরিত্রবান মানুষ হওয়ার মূল ভিত্তি সুশিক্ষা। উন্নত জাতি গঠন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। অন্যদিকে বলা যায়, সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বীজ হলো প্রথমিক শিক্ষা। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ও মানবিক গুণসম্পন্ন একজন আদর্শবান মানুষ হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রাথমিক শিক্ষা।

জাপান খুববেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ। দেশটিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন স্কুল থাকলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর জনপ্রিয়তা ও মান খুব বেশি। আমাদের দেশের চিত্র পুরোটাই উল্টো। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া হয় না। প্রাইভেট স্কুলগুলো হচ্ছে ভরসা এবং কিছুটা হলেও মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। জাপান প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করেছে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থায় মিশে আছে নৈতিক শিক্ষা। তাদের বিশ্বাস আগে নীতি-নৈতিকতা, পরে পাঠ্যশিক্ষা। তারা শিশুদের ১০ বছর পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেয় না। প্রথম তিন বছর মেধা যাচাইয়ের জন্য নয় বরং ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, পরোকারিতা, ন্যায়পরায়ণতা শেখানো হয়। যে কারণে জাপানিরা আজঅবদি নম্রতা, ভদ্রতা বা নীতি নৈতিকতায় খ্যাত। সে দেশে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক মিলে স্কুল ঝাড়ু দেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাজ নিজেরাই করেন। প্রত্যেক শিক্ষার্থী বাধ্যতামূলকভাবে মাসে একবার বেসিন ও টয়লেট পরিষ্কার করেন। স্কুলের প্রতিটি ক্লাসের শেষ বা পেছনের সারিতে অভিভাবক বা ভিজিটরের বসার জন্য আলাদা জায়গা রাখা হয়। তারা যেন ক্লাস পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং রেজিস্টারে মন্তব্য লেখতে পারেন। বিদ্যালয়ে রান্না করা খাবার শিশুদের খাওয়ানো হয়। খাবারের মান নিশ্চিতকরণের জন্য সেখানে রয়েছেন একজন ডায়েটিশিয়ান বিদ্যালয়ে শিশুদের উচ্চতা ও ওজন পরিমাপ করা হয়। কোন বাচ্চা নিজস্ব গাড়িতে করে সরাসরি স্কুলের কাছে এসে নামবে না। গাড়ি দূরে রেখে পায়ে হেঁটে স্কুলে যায়। কারণ যেসব বাচ্চাদের গাড়ি নেই তাদের মনে যাতে কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে।

এমন চিন্তা চেতনাই জাপানিদের সাফল্য এনে দিয়েছে। জাপানিরা তাদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর খুব বেশি আস্থাশীল। শিক্ষকরা সব শিশুকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। আমেরিকার রোড আইল্যান্ডে শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। জীবনমুখী এবং বাস্তবমুখী শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণের ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং এবং সিঙ্গাপুর অনুসরণ করে থাকে। তারা আমাদের মতো শিশুদের পরীক্ষায় বসিয়ে গতানুগতিক পদ্ধতিতে মেধা যাচাই করে না। আমাদের দেশে এমন ধারণা এখন কল্পনা মাত্র। আমাদের মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি নৈতিকতার ওপর জোর দেওয়া জরুরি। জাপান, আইল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো রাতারাতি শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো না হলেও তাদের অনুসরণ করা জরুরি। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৪নং অভীষ্ট হলো ‘সবার জন্য অন্তর্ভুক্তি ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি,। যার ৯.২ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা হলো ২০২০ সালের মধ্যে দেশে প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষাসহ শৈশবের একেবারে শুরু থেকেই মানসম্মত বিকাশ ও পরিচর্চার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠার নিশ্চয়তা বিধান করা। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের ৩.১৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে ‘বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। প্রাথমিক ঝরে পড়া শূন্যে নামিয়ে আনা। সর্বজনীন ও গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নিতে হবে। আর মানবসম্পদ রূপান্তরের একমাত্র পথ প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা।

ইতিহাস পর্যলোচনা করলে দেখা যায় যুগে যুগে দেশে দেশে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এর মূলে রয়েছে শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। প্রাথমিক শিক্ষা জাতি গঠনের মূল স্তম্ভ। জাতির মেধা-মনন জাগ্রত ও সভ্য জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর এ শিক্ষার মাধ্যমেই শিক্ষকরা পারেন একটি অন্ধকার সমাজকে-জাতিকে আলোকিত এবং মানুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে। শিশুরা যেন দেশের সম্পদ হয় সেই আদর্শিক-বাস্তবিক প্রাথমিক শিক্ষা অপরিহার্য। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতির মাধ্যমে শিশুরা দেশের সম্পদে পরিণত হলে বদলে যাবে মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে তৃতীয় শ্রেণির ৬৫ শতাংশ শিশু বাংলা রিডিং পড়তে পারে না। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ‘লার্নিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশন প্রমিজ ২০১৮, শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ১০০ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ২৫ জন নিজ পাঠ্যপুস্তকের সাধারণ গণিত সমাধান বা অংক করতে পারে। ৭৫ জন অংক করতে পারে না ও বুঝেও না। ফলে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা ও পুষ্টির বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এরই মধ্যে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিচালনা কমিটির সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু শুধুমাত্র সভাপতি শিক্ষিত হলে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি পাবে কি? যদি কেউ নিজের দায়িত্ববোধ থেকে শিশুদের মেধার বিকাশে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাহলেই সরকারের পদক্ষেপ সফল হতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষায় দুর্নীতি একেবারেই কম নয়। দায়িত্ব অবহেলা বড় একটি দুর্নীতি। এই ব্যাধিটি দূর হলেই প্রাথমিক শিক্ষার অনেক উন্নতি হতে পারে।

ইউনেসকোর এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল ব্যুরো ফর এডুকেশন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবেই শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত হচ্ছে না। প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার মাত্র ৫৮ শতাংশ। বাকি ৪২ শতাংশ শিক্ষকই অপ্রশিক্ষিত। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের হার প্রতিবেশী দেশ নেপালে ৯০ শতাংশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় ৮২ শতাংশ, মালদ্বীপে ৭৮ শতাংশ এবং মিয়ানমারে শতভাগ। বাংলাদেশে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৩ শতাংশ শিক্ষক অনুপস্থিত থাকেন বিদ্যালয়ে।

২০১৫ সালের এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৯৮ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষকের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০১৪ সালে বেড়ে হয়েছে ৫৭ দশমিক ২ শতাংশ। তবে নতুন জাতীয়করণ করা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই হার ২৬ দশমিক ১ শতাংশ, উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৮ শতাংশ এবং এবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের বেশির ভাগই মাদরাসায় পড়ালেখা করেছেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত মৌলিক প্রশিক্ষণ (সিইনএড, বিএড, এমএড) ছিল ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষকের। কিন্ডারগার্টেন ও এবতেদায়ি মাদরাসায় এই হার যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার বড় একটি অংশের বয়স ১০ বছরের নিচে। তারাই হবে ভবিষ্যতের জ্ঞানসমৃদ্ধ আলোকিত বাংলাদেশের বিনির্মাতা। এ জন্য দরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। গুণগত শিক্ষা দিতে হলে যোগ্য ও মেধাবীদের প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে। কিন্তু যারা শিক্ষকতায় আসছেন তাদের একটি বড় অংশ ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পান। এটা বন্ধ করার পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্পূর্ণ ভিন্ন ও উচ্চতর বেতন কাঠামো দিতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কলাম,প্রাথমিক শিক্ষা,শিক্ষাব্যবস্থা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close