প্রবন্ধ পাঠ, আলোচনাসভা,সঙ্গীত পরিবেশন ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেছে বাংলা একাডেমি ও শওকত ওসমান জন্মশতবর্ষ উদযাপন নাগরিক কমিটি। গতকাল বিকেলে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় জন্মজয়ন্তীর এই আয়োজন।

শিল্পী ইফফাত আরা দেওয়ানের কণ্ঠে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং সংস্কৃতি সচিব বেগম আক্তারী মমতাজ।

স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।

অনুষ্ঠানে ‘শওকত ওসমান : জীবন ও বিশ্ব-পাঠশালার ছাত্র’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক শান্তনু কায়সার।

আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, গোলাম কুদ্দুছ, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ ও অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, শওকত ওসমান ছিলেন আগাগোড়া একজন বিদ্রোহী-বিপ্লবী। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের প্রতিবাদস্বরূপ দেশ থেকে স্বেচ্ছানির্বাসনে গিয়ে তিনি নিজের অন্তর্গত বিদ্রোহী সত্ত্বার যেমন পরিচয় রেখেছেন তেমনি ক্রীতদাসের হাসিসহ নানা রচনায় ব্যঙ্গবিদ্রুপের মাধ্যমে মূলত অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের প্রতিবাদী অবস্থানই জানান দিয়েছেন।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, শওকত ওসমানের কাজের ক্ষেত্র ছিল কথাসাহিত্য কিন্তু তার সার্বক্ষণিক ধ্যানজ্ঞান ছিল রাজনীতি, সমাজনীতি, মানুষের মঙ্গলবোধ। প্রবলভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী এই মানুষটি একই সঙ্গে ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদীও। তার সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল বাংলার শোষিত মানুষের মুক্তি।

সংস্কৃতি সচিব বেগম আক্তারী মমতাজ বলেন, দেশবিভাগের পর শওকত ওসমান ঢাকায় এসে অসাম্প্রদায়িক, উদার মানবিক ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারায় যুক্ত হন। ষাটের দশকে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে শুভ ও কল্যাণবোধকে তার সাহিত্যিক উপাদান হিসেবে কাজে লাগিয়ে বস্তুত মানবমঙ্গলের সাধনা করেছেন।

অনুষ্ঠানে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা একাডেমির শ্রদ্ধাঞ্জলি : শওকত ওসমান স্মারকগ্রন্থ-এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

প্রবন্ধ উপস্থাপনে অধ্যাপক শান্তনু কায়সার বলেন, শওকত ওসমান জীবন তথা বিশ্ব-পাঠশালার ছাত্র হিসেবেই শিক্ষা লাভ করেছেন। নিজে শিক্ষক থেকে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি বিশ্ব পাঠশালার ছাত্র হিসেবে বুঝেছেন। তিনি আরও বলেন, শওকত ওসমান বিরাশি বছর বয়সে মারা গেছেন। আজ তার জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে। মৃত্যুর আঠারো বছর পরে কোনো একটা উপলক্ষ্যে তাকে স্মরণ করছি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে আক্ষরিক ও মর্মগত উভয় অর্থেই তিনি আছেন। তার জীবন ও সাহিত্যের মধ্য দিয়ে আমরা একথা শুনতে পাচ্ছি। জীবনের শিক্ষাই তাকে সারাদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে, শতবর্ষ পেরিয়েও শওকত ওসমান তার উত্তরসূরিদের মধ্যে মর্মরিত হয়ে চলেছেন।

অন্য বক্তারা বলেন, শওকত ওসমান ছিলেন জীবনবাদী কথাশিল্পী, মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী। নিজস্ব জীবনাভিজ্ঞতাকে তিনি ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যুক্তিবাদী মননের চর্চা করেছেন আজীবন। তিনি এক ত্রিকালদর্শী মনীষী যিনি দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা এবং একই সঙ্গে এই ধর্মান্ধ রাষ্ট্রের পতন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রক্তাক্ত জন্ম, সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী মানুষের লড়াইÑ ইত্যাদি সবকিছুর প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি তার জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক নিপীড়ন এবং ধর্মীয় উন্মাদনার অবসান না হলে বৃহত্তর মানুষের মুক্তি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

সভাপতির বক্তব্যে ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান বলেন, শওকত ওসমান বাংলার গ্রামীণ জীবনকে নিপুণ শিল্পীর দক্ষতায় তার সমগ্র সাহিত্যকর্মকে উপস্থাপন করেছেন। গভীর জীবনবোধ, ইতিহাসচেতনা ও বাস্তবতার সম্পর্কে তীক্ষœ পর্যবেক্ষণ তার কথাসাহিত্যকে বিশিষ্টতা দান করেছে। তার ব্যঙ্গবিদ্রƒপাত্মক রচনায় কৌতুকবোধ ও রসিকতার আড়ালে অন্যায়কারী ও শোষকের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার বাণী উচ্চারিত হয়েছে। তিনি বলেন, জন্মশতবর্ষ পেরিয়েও শওকত ওসমানের ‘জননী’ ও ‘ক্রীতদাসের হাসি’ এর মতো সাহিত্যকর্ম চিরকালের অপরাজেয় সাধারণ মানুষের অনন্য আখ্যান হিসেবে আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে শওকত ওসমানের গল্প অবলম্বনে সৈয়দ শামসুল হক নির্মিত চলচ্চিত্র আব্বাস প্রদর্শিত হয়।

অনুষ্ঠানে অন্যানের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শিল্পসমালোচক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামান, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, কবি মাহবুব সাদিক, সংসদ সদস্য কবি কাজী রোজী, কবি মোহাম্মদ সাদিক, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচলক লিয়াকত আলী লাকী প্রমুখ।

পিডিএসও/রানা