হাসান জাবির

  ২৩ মার্চ, ২০১৭

ভারত মহাসাগরে নতুন সম্ভাবনা

সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের শীর্ষ সম্মেলন। ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোর সংগঠন আইওআরএ বা ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের সর্বশেষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারত মহাসাগর রিম অ্যাসোসিয়েশন সামিট শীর্ষক উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এই সংস্থার গুরুত্ব তুলে ধরেন। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর ঐক্য সংহতি জোরদারের আহ্বান জানান। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থানও পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করেন তিনি। প্রতিবেশী দুই দেশের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদের সম্প্রসারণ ঘটেছে। এই সম্পদ সুরক্ষা ও সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। এদিকে লক্ষ্য রেখেই প্রধানমন্ত্রী ব্লু ইকোনমির প্রতি তার সরকারের দৃঢ় মনোসংযোগের কথা উপস্থিত বিশ্ব নেতাদের স্মরণ করিয়ে দেন। আবার নৌদস্যু, নাবিক অধিকার সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট সাধারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এই প্লাটফর্ম কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে সেদিকে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন। আঞ্চলিক সমৃদ্ধির সেতুবন্ধ হিসেবে সদস্য দেশগুলোর অভিন্ন স্বার্থ সুরক্ষায় সমন্বিত কার্যক্রম জোরদার করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে সমুদ্র সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তায় জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। এরই অংশ হিসেবে তিনি বাংলাদেশের একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। সমুদ্র নিরাপত্তা সংক্রান্ত সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এ ধরনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশের স্থল আয়তনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বড় জাতীয় জলসীমা। অথচ দেশের সমুদ্রবিষয়ক জ্ঞান চর্চার একাডেমিক সীমাবদ্ধতা প্রকট।

যতদূর জানা যায়, মাত্র কিছুদিন আগে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিষয়ক একটি বিভাগ খোলা হয়েছে। আবার এই বিভাগ চলছে সম্পূর্ণ বিদেশি শিক্ষক দিয়েই। যে কারণে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে দেশে একটি সমুদ্রবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা গেলে বাংলাদেশসহ সদস্য দেশগুলো বিশেষ উপকৃত হবে। ফলে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্যিক সমুদ্রপথ ভারত মহাসাগরের দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ, কৌশলগত ঐক্য জোরদারের পথ বিস্তৃত হবে। মূলত নৌ-পেশাদারিত্বে অনাকাক্ষিত চ্যালেঞ্জ উত্তরণ হবে সহজতর। ভারত মহাসাগরীয় রণ নিরাপত্তা ও জ্বালানি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সদস্য দেশগুলোর অন্তর্নিহিত আকাক্সক্ষাকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করবে এ ধরনের পদক্ষেপ। ফলে ব্লু ইকোনমির অপার সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নকে টেকসই রূপ দেওয়া সম্ভব হবে। তার আগে অবশ্যই

আঞ্চলিক রাজনৈতিক ঐক্য সুসংহত রাখাতে একটি সাধারণ ঐকমত্য দরকার। আর রাজনৈতিক ঐক্য বিস্তৃত হলে আঞ্চলিক পরিস্থিতিও স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে। সঙ্গত কারণেই ২১টি দেশের রাষ্ট্র, সরকারপ্রধান ও প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আইওআরএ লিডার্স সামিট আলোচনাকে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এদিকে বিভিন্ন কারণেই এই সমুদ্র এলাকায় উত্তেজনা বিরাজমান। এই উত্তেজনা সামগ্রিক সমৃদ্ধির পথে গুরুতর অন্তরায়। বহুপক্ষীয় এই উত্তেজনার কেন্দ্রে আছে দুই প্রবল প্রতাপশালী আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও চীনের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের অন্তর্ঘাত। আর এই দুটি দেশকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা। ফলে দুই আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারত ও চীন দুটি পরস্পর বিরোধী বলয়কে সক্রিয় করে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার করতে মরিয়া। এই সমীকরণে ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ জলরাশি বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্বে বাংলাদেশ এই সংস্থার প্রভাবশালী সদস্য। সঙ্গত কারণেই বৃহৎ দুই শক্তির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে আঞ্চলিক পরিস্থিতি কিছুটা অবনতিশীল। এই সংঘাতময় পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরিস্থিতি উত্তরণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। যেকোনো মূল্যে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা

রক্ষায় তিনি সব পক্ষকে উত্তেজনা পরিহারের অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির গৌরবোজ্জ্বল নিরপেক্ষ অবস্থানকে আন্তর্জাতিক পরিসরে নতুন আঙ্গিকে পরিচিত করবে। যা বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে নিঃসন্দেহে।

ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় সীমায় অবস্থিত রাষ্ট্রগুলোর আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন’, যার সংক্ষিপ্ত নাম আইওআরএ। ২০টি সদস্য দেশ সাতটি ডায়ালগ পার্টনার নিয়ে গঠিত এই সংস্থা ১৯৯৭ সালের ৬ মার্চ যাত্রা শুরু করে। যার সদর দফতর অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্র মরিসাসে। এই সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হচ্ছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, ইয়েমেন, শ্রীলঙ্কা ও সিঙ্গাপুর। অন্যদিকে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এই সংস্থার ডায়ালগ পার্টনার।

মূলত টেকসই প্রবৃদ্ধি, ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সহযোগিতার অগ্রাধিকার দিয়ে সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে পারস্পরিক স্বার্থ সুরক্ষিত রেখে সমৃদ্ধ ভারত মহাসাগর গড়ে তোলাই এই সংস্থার মৌলিক লক্ষ্য। আর এ ধরনের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে দরকার অংশীদারীভিত্তিক আন্তঃযোগাযোগ। এর ফলে পণ্য, সেবা, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি বিনিময় বৃদ্ধি করে ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব। কিন্তু ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় যে, এই সংস্থা ভবিষ্যতে সামরিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষত, চীন-ভারত দ্বন্দ্বের প্রভাবে এই সংস্থার ভবিষ্যৎ ভিন্ন দিকে মোড় নেওয়ার দাবি রাখে। মূলত বিশ্ব রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ হিসেবে এশিয়া মহাদেশ ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।

বস্তুত জ্বালানি নিরাপত্তা প্রাধান্য দিতেই বিশ্ব শক্তিগুলোর মনোযোগ এখন এশিয়া মহাদেশে নিবিষ্ট। আবার এশিয়া মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ জলরাশি ভারত মহাসাগর। এই জলসীমায় ভারতের একক আধিপত্য ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রীয় ভূমিকায় চীনের অংশগ্রহণের প্রবল আকাক্সক্ষা থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ভারত মহাসাগর এলাকা। ফলে বৈশ্বিক সমীকরণের প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের এলাকায়। বিশেষত, ভারত মহাসাগর ও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরের কৌশলগত জলরাশি দক্ষিণ চীন সাগরের বহুজাতিক সার্বভৌম বিরোধ চরম সঙ্কটাপন্ন। আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তির সঙ্গে চীন এখানে প্রায় যুদ্ধের মুখোমুখি অবস্থানে আছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভারত মহাসাগরীয় রণ স্থিতিশীলতা ভারতের প্রয়োজন। এই জলরাশিতে দিল্লির স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা যেন বিপন্ন না হয় সেদিকে গুরুত্ব দিয়েই এই সংস্থায় ভারত নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। আর সে কারণেই আন্তর্জাতিক পর্যালোচনায় ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনকে ভারতের জাতীয় আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব মনে করে, এই সংস্থা ভারতের স্বপ্ন। সব মিলিয়ে এই সংস্থার সর্বশেষ সম্মেলন সদস্য দেশসমূহের মধ্যে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির বিস্তার ঘটিয়ে সমৃদ্ধির পথে এক ধাপ এগিয়ে গেছে। এর মাধ্যমে ভারত মহাসাগরীয় সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে নিঃসন্দেহে।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তাবিশ্লেষক

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আন্তর্জাতিক,হাসান জাবির,ভারত মহাসাগর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist