মো. কায়ছার আলী

  ১৬ জুন, ২০১৯

আজ বাবা দিবস

প্রতিটি শিশুই আগামী দিনের পিতা

‘মরিয়া বাবর অমর হইয়াছে, নাহি তার কোন ক্ষয়, পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়’। মহামতি দিল্লির সম্রাট বাবর ছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি স্বীয় বীরত্ব ও বিচক্ষণতায় মোগল বংশের ভিত রচনা করেন। প্রাণপ্রিয় ছেলে হুমায়ুনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন করে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে স্নেহবৎসল বাবা হিসেবে অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন। তার ছেলে হুমায়ুন কঠিন রোগে আক্রান্ত। রাজ্যের সব বিজ্ঞ চিকিৎসকরা তাকে সারিয়ে তোলার কাজে সদা নিয়োজিত। কিন্তু এই অজ্ঞাত রোগ থেকে রাজকুমারের পরিত্রাণ হচ্ছে না। অস্ত রবির মতো তার জীবন প্রদীপটা ক্রমে নিভে আসছে। বাবর হেকিমদের ডেকে ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইলেন এই রোগ থেকে শাহজাদা মুক্তি পাবে কি? উত্তরে সবাই নীরব নিস্তব্ধ। এই নিষ্ঠুর নীরবতা বাদশাহর বুকে শেল হয়ে বিঁধল। এমনই সময় জনৈক দরবেশ বললেন, সম্রাট যদি তার শ্রেষ্ঠ ধন মহান আল্লাহর উদ্দেশে উৎসর্গ করতে পারেন তবেই আল্লাহর রহমতে শাহজাদার প্রাণ রক্ষা পেতে পারে। বেদনাবিধুর সম্রাট গভীরভাবে উপলদ্ধি করলেন, তার সর্বশ্রেষ্ঠ ধন তার নিজ জীবন। তবু তার কোনো শঙ্কা নেই। তিনি আন্তরিকভাবেই চান তার জীবনের বিনিময়ে ছেলের জীবন বেঁচে থাক। তখন বাবর নিজ গৃহে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে নিজ জীবনের বিনিময়ে ছেলের রোগমুক্তি কামনা করেন। আল্লাহ পাক তার প্রার্থনা কবুল করলেন, সেই দিন থেকে বাবরের রোগ লক্ষণ দেখা দিল এবং হুমায়ুনের রোগমুক্তি হলো। মহান বাবার মৃত্যুর অতল জীবন ফিরিয়ে দেন ছেলের নতুন ঊষার আলো। বাৎসল্য বাবর এই মৃত্যুর মধ্যদিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন। আসলে বাবা চিরকালই বৃক্ষ। আপন প্রাণরস দান করে ফল সতেজ রাখাই বৃক্ষের ধর্ম। বাবাও তাই প্রাণরস দান করে সতেজ রাখেন ছেলে নামক ফলকে। আর এভাবেই জন্মদাতা, বাবা বা বাবাদের ভালোবাসা, আদর, সোহাগ, সন্তানের প্রতি অক্টোপাসের মতোই মায়ার জালে বন্দি হয়ে আছে সৃষ্টির শুরু থেকে পৃথিবীর ধ্বংসের শেষদিন পর্যন্ত।

আজ বাবা দিবস। প্রতি বছরের জুন মাসের তৃতীয় রোববার সারা বিশ্বজুড়ে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে বাবা দিবস। ১৯১০ সালে আমেরিকার সেনোরা লুইসের একান্ত প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মতো বিশেষ এই দিনটি উদযাপিত হয়। সেনোরা ছিলেন ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা ইলেন স্মার্ট যখন মারা যান তখন সেনোরার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা উইলিয়াম স্মার্ট সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব নেন। সারা ক্ষণ তিনি তাদের দেখেশুনে রাখতেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও স্মার্ট তাদের মায়ের অভাব এতটুকু বুঝতে দেননি। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্থায়ীভাবে বাবা দিবসকে রাষ্ট্রীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাৎপর্যের সঙ্গে পালিত হচ্ছে বাবা দিবস। ১৯৭৪ সালে সেনোরা স্মার্টকে তার অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও আজ নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে বিভিন্ন তারিখে বাবা দিবস পালিত হলেও আজ ৮৭টি দেশে বিশ্ব বাবা দিবস পালন করছে। এই পৃথিবীতে অনেক ঘটনাই ঘটে যা কল্পনার অতীত বা চিন্তার বাইরে। প্রাচীন ইরানের মহাকবি ফেরদৌসী (যেহেতু তিনিও একজন মহান বাবা) তার মেয়ের সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য গজনীর সুলতান মাহমুদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতিটি শ্লোকের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দেওয়ার শর্তে পৃথিবীর অন্যতম মহাকাব্য শাহনামা সাতটি বৃহৎ খন্ডে ৬০ হাজার শ্লোকে ৩০ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করে রচনা করেন। মহাকাব্য গ্রন্থটি প্রাচীন ইরানের রাজা-বাদশাহ ও বীর পুরুষদের কাহিনি নিয়ে রচিত। ষড়যন্ত্রকারীদের কুবুদ্ধিতে সুলতান মাহমুদ ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে ৬০ হাজার রৌপ্যমুদ্রা মতান্তরে ৬০ হাজার দিরহাম প্রদান করেন। স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে ক্ষোভে, ক্রোধে ও দুঃখে কবি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে অনেক দেরিতে সুলতান নিজের ভুল বুঝতে পেরে প্রাপ্য ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দূত মারফত কবির বাড়িতে প্রেরণ করে জানতে পারেন যে, কবি আর পৃথিবীতে নেই। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কবির মেয়ে সেই স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করেননি। সেই মহাকাব্যের গৌরবগাথা সোহরাব-রোস্তম অর্থাৎ বাবা-ছেলের অমর কাহিনি আজ সারা বিশ্বে প্রচারিত। প্রাচীন ইরানের জাতীয় বীরযোদ্ধা মহাবীর রোস্তম তার অতুলনীয় শক্তি ও সাহসের জন্য পৃথিবীর মানুষের কাছে কিংবদন্তির মহানায়ক। মহাবীর রোস্তম যেমন একজন জাতীয় বীর তারই ছেলে সোহরাব তার বাবার যোগ্য উত্তরাধিকারী। মহাবীর রোস্তমের জীবন অত্যন্ত করুণ এবং মর্মন্তুদ। কৌশলে বীরত্বের রীতির কথা বলে পরের দিন নিজেই সুযোগ বুঝে তীক্ষè ধার তলোয়ার বের করে সোহরাবের বুকে ঢুকিয়ে দেন। সোহরাবের বুকের তাজা রক্তের সঙ্গে সঙ্গে বের হতে থাকে প্রকৃত পরিচয়। ধীরে ধীরে সোহরাবের নিস্পন্দ দেহ বাবার বক্ষে আশ্রয় লাভ করে। তখন নির্জন গিরিপথে কোনো প্রাণী ছিল না। আকাশের সূর্য এসে সোহরাবের মুখে পড়েনি। কোনো বিদায় রাগিনী বেজে ওঠে সেই বিদায় দৃশ্যকে বিহ্বল করেনি। তখন রোস্তমের বুকফাটা হাহাকার আর কান্না পাহাড়ে ধাক্কা লেগে এক বেদনাবিধুর বিলাপ তৈরি করেছিল : সোহরাব ফিরে আয় বাবা, ফিরে আয় সোনামানিক, কথা বলো বাবা, বাবা বলে একবার ডাক। প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে বারবার বলছিল নেই সোহরাব নেই। দিবসের শেষ সূর্য যখন পর্বতের ওপারে ঢলে পড়ল, তখনো হতভাগ্য মহাবীর রোস্তম ছেলের প্রাণহীন দেহ বক্ষে ধারণ করে বারবার বলছেন : আয় সোহরাব ফিরে আয়। মহাবীর রোস্তম বীর হিসেবে যুদ্ধে একবার জিতেছেন কিন্তু বাবা হিসেবে চিরতরে হেরে গেছেন।

মোগল সম্রাট শাহজাহান এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু হলো ‘বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ’। হৃদয়ের অকৃত্রিম বন্ধনে বদ্ধ বাবা এবং সন্তান। তাই সন্তানের চোখ দিয়ে পানি পড়লে বাবাদের চোখ দিয়ে রক্ত ঝরে। সন্তান অসুস্থ হলে বাবাদের হৃদয় পুড়ে যায়। কষ্ট পেলে মনে বা অন্তরে ঘা হয়, ব্যথা পেলে বেদনার ছাপ তাদের চোখে মুখে আপ্লুত হয়। বাবাদের ভালোবাসা বর্ষার নদীর উপচেপড়া ঢেউয়ের মতো, ঝর্ণার ঝর ঝর ধারার মতো, প্রকৃতির মায়াবিনী রুপের মতো, সকালের সোনাঝরা রোদের মতো আর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দের মতো। সন্তান জন্মের আগে থেকেই একবুক ভালোবাসা আর সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কীভাবে গড়বে তার চিন্তায় সারা দিন মগ্ন থাকেন বাবা। কী খাবে? কোথায় পড়বে? কোন খেলনা পছন্দ করবে? কীভাবে আলোকিত মানুষ হবে? আরো অনেক কিছু? বিয়ের দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর পর আমার এক বন্ধুর স্ত্রীর সন্তান হওয়ায় তার যে কি সীমাহীন আনন্দ, আমি নিজে তা দেখে লিখছি। সর্বদা তার কোলে রাখত তার ছেলেটিকে। তার কাছেই শুনেছি আমি দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর পর বাবা হয়েছি এই সন্তানের মাঝেই আমি চিরকাল বেঁচে থাকব। Child is the Father of a Man আজ আমরা (সন্তানেরা) অনেক বড় হয়েছি আর আমাদের বাবারা হয়েছেন বৃদ্ধ। একটু পেছনে ফিরে তাকালেই স্মৃতির অ্যালবামে কিংবা ঘরের দেয়ালের ছবিতে দেখা যায়, বাবা কোলে নিয়ে কিংবা আদর করে, চুমু দিয়ে সন্তানের সঙ্গে বা পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন কালের সাক্ষী হিসেবে।

বাবা দিবস আজ থেকে পৃথিবীর সর্বত্র সফল হোক, সার্থক হোক এ প্রার্থনা করি। তবে পৃথিবীর সব সন্তানেরা তাদের বাবাদের যথাসাধ্য বৃদ্ধ বয়সে তাদের পরিবারের মধ্যে রেখে পরম যত্ন অসীম, ভালোবাসা, সেবা ও শুশ্রুষা দিয়ে বাবার চোখের পানি মুছে দিয়ে সব হতাশা আর হাহাকার ব্যথা বেদনান কষ্ট যেন চিরতরে ভুলিয়ে দিতে পারে এবং স্মৃতির মণিকোঠা থেকে চিরতরে হারিয়ে ফেলতে পারে? কিন্তু আমরা তা পারি না বলেই, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভুবনবিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নচিকেতার অমর আকুতি, বেদনা, মিনতি ও আক্ষেপ ভরা ওই কালজয়ী গানটি—‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার। মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি। সবচে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলে আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম—আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম...’। গানটি আমাদের ক্ষতবিক্ষত করলেও কেন জানি বোধের দরজা খুলতে পারেনি। কোনো এক বিষবৃক্ষের কারণে বোধহীন হয়ে পড়ে আছি বিশ্ব মানচিত্রে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পিতা,শিশু,বাবা দিবস
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close