জুবায়ের চৌধুরী

  ১৭ অক্টোবর, ২০১৭

অপ্রতিরোধ্য সোনা চোরাকারবারিরা

অপ্রতিরোধ্য দেশের সোনা চোরা-কারবারিরা। বিমানবন্দরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যেও সক্রিয় তারা। চলছে সোনা পাচার। কোনোভাবেই তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না। বৈধ বা অবৈধভাবে দেশে আসা সোনার সম্ভাব্য গন্তব্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে। কারণ, ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ভারতে সোনার চাহিদা হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। এরপর থেকে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলো দিয়ে সোনা পাচারের ঘটনা বেড়ে যায় বহুগুণে। আবার অস্ত্র, মাদক ও হুন্ডির বিনিময় মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই মূল্যবান ধাতুটি। উদ্বেগজনক হারে চোরাচালান বেড়ে যাওয়ায় শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

দেশে প্রতি বছর সোনার চাহিদা প্রায় ২১ টন। কিন্তু গত ১০ বছরে এক তোলা সোনাও আমদানি করা হয়নি। ওই পরিমাণ সোনার মধ্যে সর্বোচ্চ শতকরা পাঁচ ভাগ এসেছে ব্যাগেজ রুলের আওতায়, বাকি ৯৫ শতাংশ কীভাবে আসছে, তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। আর সোনা আমদানিতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় সুযোগ নিচ্ছে চোরাচালান চক্র। দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। যে কারণে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সোনা চোরাচালান রোধের বিষয়টি। সোনা পাচারের সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য ট্রানজিট রুট বাংলাদেশ। আর পাচারের নিরাপদ পথ বিমানবন্দর। তবে বাস ও ট্রেনে সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরা, বেনাপোল, কুষ্টিয়া, যশোর, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী দিয়ে পাচার হচ্ছে ভারতে। সোনা পাচারে দুই বাংলায় গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সক্রিয় এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কাতার, ওমান, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের দেশগুলোর সোনা ভারতে পাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাকারবারিরা। পাচারকারীরা বিদেশে বসেই সোনা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

পর্যাপ্ত নিরাপত্তা আর উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেও ঠেকানো যাচ্ছে না সোনা পাচারের ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই ধরা পড়ছে সোনার বার। গত এক বছরে দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে প্রায় ৬২৩ কেজি সোনা জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। এসব ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ৬৯টি। হাতেনাতে গ্রেফতারও হয়েছেন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীসহ বিমানবন্দরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তবে চোরাচালান যারা করেন, তাদের কাউকে ধরা যায়নি এখনো। আর এখন পর্যন্ত সোনা চোরাচালানে জড়িত কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। কারণ সোনা চোরাচালানে শুধু বাহকরাই ধরা পড়ছেন, মূল হোতারা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

দেশি-বিদেশি অর্ধ শতাধিক প্রভাবশালী চোরাচালানকারী বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। মাঝে মধ্যে সোনার চালান ও বহনকারী আটক হলেও চোরাকারবারির গডফাদাররা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কারণে থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর দিয়ে চোরাচালানে জড়িত প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সোনা পাচার ঠেকাতে অভিযান শুরু করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ লক্ষ্যে এরইমধ্যে সোনা চোরাকারবারিদের তালিকাও তৈরি করেছে র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ। র‌্যাবের তালিকায় নাম আছে ১৫০ চোরাকারবারির। আর গোয়েন্দা পুলিশের তালিকায় শতাধিক চোরাকারবারির নাম আছে। সেই তালিকা ধরে শিগগিরই অভিযান শুরু হবে। তালিকায় অনেক রাজনীতিকেরও নাম আছে।

এদিকে, বিভিন্ন সময়ে বিমানবন্দরে যেসব চোরাচালান ধরা পড়ছে, এর নেপথ্যে রয়েছে চোরাকারবারিদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের বনিবনা না হওয়া ও তাদের সঙ্গে পাচারকারীদের বনিবনা না হওয়া। তবে যে পরিমাণ ধরা পড়ছে, তার চেয়ে বহুগুণ নির্বিঘেœ পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর চোরাচালানের ঘটনার মামলায় বহনকারীরা অভিযুক্ত হলেও মূল হোতারা বরাবরই থেকে যাচ্ছে আড়ালে। গত পাঁচ বছরে প্রায় সাড়ে ৮০০ কেজি সোনা ধরা পড়লেও কোনো গডফাদার ধরা পড়েনি। যে পরিমাণ ধরা পড়ে তা পাচার হওয়া সোনার দশ ভাগের এক ভাগ মাত্র।

সোনা পাচারে কৌশল অনেক : সোনা চোরাচালান সাধারণত ব্যবহৃত হচ্ছে খাতা পদ্ধতি ও স্কেল পদ্ধতি। চোরাকারবারিরা সংকেত হিসেবে খাতা ও স্কেল শব্দ ব্যবহার করে। খাতা পদ্ধতি হলো ফ্লাইট ব্যবহার করে চোরাচালান আর স্কেল পদ্ধতি হলো শরীরে লুকিয়ে সোনা পাচার। খাতা পদ্ধতিতে সোনা চোরাচালানের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর এ পদ্ধতিতে একটি কালো অথবা মেরুন কাপড় ব্যবহার করা হয়। কাপড়ের ওপর ১২০ থেকে ১৫০টি সোনার বার রাখা হয়। পরে তা সেলাই করে মোটা পাপসের আকার দেওয়া হয়। শাহজালালের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সোনার চালান ১২৪ কেজি আসে খাতা পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক মাফিয়াচক্রের সঙ্গে জড়িত বিমানের কেবিন ক্রু, পাইলট, শিডিউল কর্মকর্তা এবং প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে, স্কেল পদ্ধতিতে শরীরের মধ্যে লুকিয়ে সোনা পাচার করা হয়। বেল্টের আড়ালে এবং প্যান্ট ইন থাকায় স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সোনার অবস্থান সহজে বোঝার উপায় থাকে না। এ পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে আট কেজি সোনা আনা যায়। স্কেল পদ্ধতি ব্যবহার করে আনা সোনা প্রতিদিনই জব্দ হচ্ছে। এই দুই পদ্ধতি ছাড়াও কখনো ট্রলি ব্যাগ, মুঠোফোনের ব্যাটারি রাখার স্থান, কনুইয়ের ভাঁজসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে করে সোনা পাচারের ঘটনা রয়েছে। মূলত খাতা ও স্কেল পদ্ধতি ব্যবহার করে দেশের বড় বড় সোনার চালান এসেছে।

জব্দ হওয়া সোনা যায় কোথায় : শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে স্বর্ণ জব্দ করে। ওই স্বর্ণ ঢাকা কাস্টমস হাউসের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে একটি জিআরও নম্বরের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয়। ঢাকা কাস্টমস হাউস উদ্ধারকৃত ওই স্বর্ণের নিষ্পত্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংকে। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের মালিকানা দাবি করে কেউ যদি ওই স্বর্ণ নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ করে, তাহলে তারা তা নিয়ে যেতে পারে। তবে কেউ যদি দাবি না করে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ওই স্বর্ণ নিলাম করে। এরপর বাংলাদেশে জুয়েলারি ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরা তখন ওই স্বর্ণ নিলামে কিনে বিক্রি করে। আর নিলামে বিক্রি করা ওই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের (সিআইআইডি) মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, সোনা চোরাচালানের সঙ্গে বিমান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন, এমনকি অনেক রাঘববোয়ালও জড়িত। এরই মধ্যে অনেক রাঘববোয়াল গ্রেফতার হয়েছে।

জব্দ হওয়া সোনার চালান : গত এক বছরে ৬২৩ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩০৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এসব স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় ২১ জন চোরাকারবারিকে আটক করা হয়েছে। অন্যদিকে, গত চার বছরেরও কম সময়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর উদ্ধার করেছে এক টনেরও বেশি স্বর্ণ। এসব স্বর্ণের দাম ৫২০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। তবে গত চার বছরে উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের মধ্যে কী পরিমাণ স্বর্ণ নিলামে বিক্রি করা হয়েছে, কী পরিমাণ স্বর্ণ এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা আছে, সে তথ্য নেই শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের কাছে।

সূত্র জানায়, গত চার দশকে জব্দ হওয়া প্রায় কয়েক টন সোনা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপদ ভল্টে গচ্ছিত। এ সোনার সবটুকুই যোগ হয়েছে বর্তমান রিজার্ভ ফান্ডের সঙ্গে। এ যাবৎ বিমানবন্দরে আটক করা সোনার কোনো মামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ার নজির দিতে পারেনি আদালত ও পুলিশ। শুধু গত পাঁচ বছরেই মামলা হয়েছে ২১২টি। এর অধিকাংশই চার্জশিট হলেও আদালতে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি একটিরও। যারা ধরা পড়েছেন তাদের বেশির ভাগই জামিনে বের হয়ে ফের সোনা চোরাচালান করছেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সোনা চোরাচালান,বিমানবন্দর,অপরাধ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist