জুবায়ের চৌধুরী

  ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯

অপরাধই যেন জীবিকা কিছু বিদেশির!

অতিথিপরায়ণ দেশ হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত বাংলাদেশ। গত এক দশকে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে এগিয়েছে দেশ। বইছে উন্নয়নের জোয়ার। তাই বিভিন্ন অনুন্নত দেশগুলো থেকে চাকরি, ব্যবসা বা শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসছে বিদেশিরা। অন অ্যারাইভাল ভিসার সুযোগ নিয়ে এ দেশে ঢুকছে বিদেশি নাগরিকরা। এসব বিদেশির বেশিরভাগ ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও অবৈধভাবে থেকে যাচ্ছেন। এসব অবৈধ বিদেশি নাগরিক এটিএম কার্ড জালিয়াতি, মাদক কারবারি ও জাল মুদ্রাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে অবস্থানকারী এ রকম ১৫ হাজার বিদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। তাদের নিয়ে বিপাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, হেন অপরাধ নেই যে এসব অবৈধ বিদেশি জড়িত না। বাংলাদেশে অবৈধভাবে থাকতে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেই বিদেশি এসব অপরাধী নিজের পাসপোর্টটি ছিঁড়ে ফেলে। আটক বা গ্রেফতার হওয়ার পর ইংরেজি জানা থাকলেও নিজের স্থানীয় ভাষায় কথা বলে বিভ্রান্তিতে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। ভাষাসংক্রান্ত জটিলতায় তাই জানা যায় না ওই বিদেশি কোনো দেশের নাগরিক। এভাবেই বাংলাদেশে থাকছে তারা। জানা গেছে, দেশি-বিদেশিদের সমন্বয়ে গড়া এসব অপরাধী চক্রকে পরিচালনা করা হয় বিদেশের মাটিতে বসে। অপরাধের শেকড় বিদেশে থাকায় আড়ালেই থেকে যাচ্ছে মূল অপরাধীরা। আবার বাংলাদেশ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে।

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে ১৫ হাজারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থান করা ১০৯টি দেশের এসব নাগরিকের মধ্যে ১৪টি দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এসব বিদেশি অপরাধীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে নাইজেরিয়ার নাগরিকরা। এরপর রয়েছে ঘানা, সুদান, কঙ্গো, আলজেরিয়া, লিবিয়া ও উগান্ডা। সারা দেশের কারাগারগুলোতে বন্দি আছে ৭শ’র বেশি বিদেশি নাগরিক। এদের মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত রয়েছেন ৭৯ বিদেশি নাগরিক।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, শুধু রাজধানীতেই গত বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত আর্থিক প্রতারণার ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে ২৬ বিদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে ২০ জনই আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ার নাগরিক। বাকি ৬ বিদেশির মধ্যে তিনজন ক্যামেরুনের নাগরিক। কঙ্গো, পোল্যান্ড ও চীনের নাগরিক রয়েছেন একজন করে। তারা সবাই অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন। অন্যদিকে কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মাদক চোরাচালান, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অপরাধে সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও শতাধিক বিদেশি নাগরিক কারাগারে বন্দি রয়েছে। এদের মধ্যে সাজার মেয়াদ শেষে অতিরিক্ত দুই বছর জেলে আছেন ৮০ জন।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে বিশ্বের অনেক অনুন্নত দেশের মানুষের কাছে বাংলাদেশ একটি আকর্ষণীয় দেশ। বিশেষ করে আফ্রিকান অনেক দেশ থেকে এখন বিদেশিরা এ দেশে আসছেন। তবে এদের একটি অংশ আসে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। তারা প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মের সঙ্গে জড়িত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাতে আটক হলে তারা ইংরেজিতে কথা না বলে স্থানীয় ভাষায় কথা বলে। এটা তাদের একটা কৌশল। তাই তার ন্যাশনালিটি জানা সম্ভব হয় না। র‌্যাব মহাপরিচালক জানান, আবার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তারা ছিঁড়ে ফেলে দেয় তাদের পাসপোর্ট। ফলে বোঝা যায় না তারা কোন দেশের নাগরিক। কোন এয়ারলাইনসে বাংলাদেশে এসেছে তাও শনাক্ত করা যায় না। তাই বাধ্য হয়ে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। পরে এ দেশীয় সহযোগীরা তাদের জামিনে বের করিয়ে নেয়। জেল থেকে বের হয়েই তারা আবারো শুরু করে অবৈধ কাজ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত বছর পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) রাজধানীতে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। এসবির ২৯টি টিম রাজধানীর বসুন্ধরা, বারিধারা, গুলশান, বনানী, নিকুঞ্জ, পিংক সিটি, লেকসিটি কনকর্ড, উত্তরা ও মতিঝিলসহ ১৯টি এলাকায় অবস্থানকারী ১ হাজার বিদেশির তথ্য সংগ্রহ করে। ওই অভিযানে দেখা যায়, প্রায় ১০ হাজার বিদেশি বাংলাদেশে অবস্থান করছে। আর এসব বিদেশি নাগরিকদের অনেকেরই বৈধতা নেই।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিনিয়োগ বোর্ড, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি বা বেপজা, নন-গভর্মেন্ট অর্গানাইজেশন (এনজিও), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ক্রীড়াঙ্গন ও ইমিগ্রেশন বিভাগের মাধ্যমে বিদেশি নাগরিকরা বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি পায়। এর মধ্যে শিল্প ও সেবা খাত সংশ্লিষ্টরা আসে বিনিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে। স্বরাষ্ট্র ও ইমিগ্রেশন বিভাগের মাধ্যমে আসে ট্যুরিস্ট, ওয়ার্ক পারমিট লাভকারী ও স্টুডেন্ট ভিসায় আসা নাগরিকরা। বেপজা ও এনজিও ব্যুরো নিয়ন্ত্রিত হয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মাধ্যমে। অন্যদিকে খেলতে আসা বিদেশিরা আসেন ক্রীড়াঙ্গনের বিভিন্ন ক্লাবের আমন্ত্রণে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশে আসা বিদেশিদের বিষয়ে কাজ করে এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের একাধিক ডেস্ক। তবে এসব ডেস্কের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব প্রকট। আর এই সমন্বয়হীনতার কারণেই যথাযথভাবে বিদেশি নাগরিকদের বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান ও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগরের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, নাইজেরিয়া, ঘানাসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশিদের অতিথিপরায়ণতার সুযোগ নিয়ে এ দেশে আসে। পরে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণামূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে তারা। প্রতারক এসব বিদেশির অনেকেরই পাসপোর্ট থাকে না। আবার কারো পাসপোর্ট থাকলেও তাতে ঠিকানা থাকে ভুয়া। তাই তাদের আদালতে হাজির করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এসব বিদেশি নাগরিক পরে আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে আবার একই অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অপরাধ,বিদেশি,জীবিকা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close