কাঞ্চন বিধু
ভক্তি ভরে সপিত মন প্রেমের মানত
কবিতা লিখি না, আঁকি। শব্দ রংতুলি। আঁচড় কাটি আবেগে, অনুভবে। শব্দের পর শব্দ বুনি। গল্প করি। ছবি আঁকি। কবিতা আমার কাছে মেলায় দেখা বায়োস্কোপের মতো। দৃশ্যের পর দৃশ্য, গল্প, কান্না। পরম্পরা কথা বলে মুখগুলো। কত রং রূপ রস, আনন্দ। বাড়ি ফেরার পথে, ঘুমে-বিশ্রামে, কাজে-ব্যস্ততায়, কানে বাজে বায়োস্কোপের সেই লোকটার ছন্দের তালে তালে বলে চলা গান- ‘এই তার পরেতে আইয়া গেল, সোনাভানকে দেখা গেল...।
কবিতাকে এমন করেই দেখেন কবি প্রতীক ইজাজ। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখিটা নেশা। গান করেন ও লেখেন। গদ্য বেশ ঝরঝরে। তবে কবিতার ধরনটা আলাদা ও ব্যতিক্রমী। প্রকাশে ও প্রকরণে নিজস্ব ধারা আছে তার। বোঝা যায়। কবিতাগুলো গল্প হয়। শব্দ, বিষয় ও উপমা এমনভাবে আনেন, যেন পাঠকের অপ্রকাশিত শব্দ, আবেগ, বোঝাপড়া সাবলীলভাবে বলে যান তিনি অবলীলায়। তাই পাঠকই হয়ে ওঠেন কবি।
এই কবির এমন এক ব্যতিক্রমী কাব্যগ্রন্থ এসেছে একুশের গ্রন্থমেলায়। নাম ‘ফাতেমা ও রাজকুমারের বয়ান’। ঠিক কাব্যগ্রন্থ নয়, বলা চলে গীতিকাব্য বা গীতিআলেখ্য। লোকজ ধারায় লেখা বাঙালির চিরায়ত প্রেম-উপাখ্যান। ফাতু স্কুলপড়ুয়া কিশোরী। কাশু সদ্য কৈশোর পেরোনো যুবক। শিমুলের লাল ফাতুকে টানে। কাশুর মেঘচুল, প্রেম হয়ে ভাসে ফাতুর আকাশে। কাশুকে টানে বিপ্লবের লাল। ওরা লাল পতাকার মিছিলে যায়, মঞ্চ করে, পোস্টার সাঁটায়। আবার কাদায় মুখ গোঁজে, নিঃশব্দে হাঁটে অন্তরীণের পথে।
কেবল মন তাড়ানিয়া উপমা বা শব্দপ্রকরণই নয়; এই গ্রন্থের ব্যতিক্রম ধরনটা উপস্থাপনায়। বিশেষ করে দোহার পর্বে। মূল চরিত্রের বাইরে একজন দোহার আছেন। সহজ-সরলভাবে পুঁথি পাঠ করেন। পঠনরীতি আলাদা। বেশ কিছু অলঙ্করণ আছে। কবি নিজেই বলছেন এটি তার ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। গ্রামের এক কিশোরী ও সদ্য কৈশোর পেরুনো যুবকের প্রেমকাহিনি। ভীষণ তাড়ানিয়া, খলবল প্রেম। তবে চারপাশে দেখা বা চেনা যে প্রেম, ঠিক তেমনটা না। অথচ সেই প্রেমের জন্যই কতটা কষ্ট পেতে হলো ছেলেমেয়ে দুটোর। কী মর্মন্তুদ পরিণতি!
পাঠককে টানবে তো- জানতে চাইলে প্রতীক ইজাজ বলেন, টানবে কিনা জানি না। তবে ভালো লাগবে। আবেগ কাজ করবে। একটা উপলব্ধি অন্তত বোধ হবে মনে। কাশু আর ফাতুকে ঘরের, মনের স্বজন মনে হবে। খুব সহজ-সরলভাবে, বায়োস্কোপ যেমন, সেভাবেই দৃশ্যায়ন করেছি। ধরনটাও আলাদা। ফাতু ও কাশুর গভীর প্রেম। অথচ অপ্রকাশিত। একেবারে ঘরের গল্প বলা চলে। কিছুটা দেখি। কিছুটা দেখি না। কীভাবে যে অন্তরীণ হলো ওরা; কেনইবা হলো; ওদের জন্য কি কিছুই করার ছিল না কারো? এমন প্রশ্ন অপরাধী করে আমাকেও। লাল চোখ নিয়ে ওদের মুখ দুটো ভাবি। একটা দীর্ঘশ্বাস খেলে যায় ভেতরে। কী তাড়ানিয়া প্রেম!
তার মানে কবিতা না বলে একটা দীর্ঘ গল্প বলা যেতে পারে? কবির উত্তর- হ্যাঁ, একটাই কবিতা বা কাহিনি। মানে কাব্যচিত্র। গল্পটার কয়েকটা ভাগ আছে। একবার ফাতু, একবার কাশু- এভাবে সাজানো। তৃতীয় ব্যক্তির বয়ানে। প্রত্যেক বয়ানের নির্দিষ্ট নাম আছে। আবার এই বয়ানগুলোকেও ভাগ করা হয়েছে নির্দিষ্ট কাহিনির আলোকে। তবে সহজ পাঠের জন্য একজন দোহার আছেন। এই দোহারই বিশেষ পাঠরীতির মাধ্যমে পাঠককে পরের পর্বের সঙ্গে পরিচিত করে দেয়। মঞ্চ নাটকে যেমনটা হয়। যদি কেউ দোহারের অংশটুকুর বিশেষ পাঠরীতি আয়ত্ত করতে পারেন, তবে পড়াটা সুখকর হবে।
কিভাবে এলেন এই দোহার? কবি বলেন, যখন মঞ্চ নাটক করেছি বা এখনো যখন সংগঠনে আবৃত্তি প্রযোজনার জন্য কাজ করাই, সংগঠনের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখি, দোহারের বিষয়টি মাথায় রাখি। দোহার আমাকে ভীষণ টানে। কি সহজ-সরলভাবে গল্পের বর্ণনা করে যান তিনি। মেলায় দেখা সেই বায়োস্কোপের লোকটার মতো। কী মধুর সুর, দীপ্ত কণ্ঠ। এখানেও তেমনি দোহার আছে। ওই দোহারই মায়াকণ্ঠে কাশু ও ফাতুকে আঁকেন। বিশেষ করে ‘অন্তিম বয়ানে’ দোহারের বুজে আসা কণ্ঠ নিশ্চয় পাঠককেও কাঁদাবে। আমার বিশ্বাস সজল চোখ নিয়েই পাঠ শেষ করতে যেকোনো আবেগময় পাঠককে।
দোহারের কিছু অংশ- ‘ঘরে ছিল রাজকন্যা বাহিরে পুত্র/আসা-যাওয়ায় ঘর সংসার প্রণয় সূত্র/শান শওকত রাজ্য বাদ্যি হিরে জহরত/ভক্তি ভরে সপিত মন প্রেমের মানত’। কিংবা ‘আকাশ কান্দে বাতাস কান্দে কান্দে জলের মাছ/বাঁকা গাঙের পানি কান্দে হরিৎ সবুজ গাছ/সেই গাঙেতে ভেড়ে একদিন প্রেমের সাম্পান/গাঙের মরা ঘাটের জলে সপে রে তার প্রাণ!’
শুধু প্রেম নয়, আছে যাপিতজীবনও। একটা গোটা সংসার বলা চলে। প্রেম বিরহ, আনন্দ যেমন আছে; তেমনি খুঁটিনাটি বিষয়, অলঙ্কারও আছে। ফাতুর জন্য বাবা-মায়ের উদ্বেগ আছে। আবার কাশুর জন্য গ্রামসুদ্ধ মানুষের উৎকণ্ঠাও কম নয়। রাজনীতি এসেছে। লাল ঝান্ডার বাম রাজনীতি। গ্রামের ছেলে কাশুর চোখেও সাম্যবাদ খেলে। ওদের জন্য মঞ্চ করে। বাঁশ কাটে। দেয়ালে পোস্টার সাঁটায়। আর ফাতুকে টানে ঘরের তাকে সাজানো ইলা মিত্র, মনোরমা বসু, লাল লাল বই।
‘ফাতেমা ও রাজকুমারের বয়ান’ প্রকাশ করেছে চৈতন্য। প্রচ্ছদ রাজীব দত্তের। প্রচ্ছদে নর-নারীর মধ্যকার সম্পর্কের একটা টানাপড়েন বোঝা যায়। ভেতরে দোহার পর্বের জন্য অলঙ্করণ করেছেন হায়দার আহমেদ। পাঁচ দোহারের প্রতিটির সঙ্গে পৃষ্ঠাজুড়ে একটি করে বিষয়ধর্মী ছবি। ওই ছবিগুলো কাশু ও ফাতুকে আরও নিবিড় করে তুলবে পাঠকের কাছে। বইটির মূল্য ১৪০ টাকা।
বছরের অন্য সময় প্রকাশ না করে মেলায় কেন? প্রতীক ইজাজের সরল স্বীকারোক্তিÑএতটা লেখক হয়ে উঠতে পারিনি। তাছাড়া সময়ও হয় না। একজন সাংবাদিকের এত সময় হয়ে ওঠে না। কিছু পান্ডুলিপি গুছিয়ে রেখেছি। করবো করবো ভেবেও কুলোতে পারি না। কাজের ব্যাপারে আমি সতর্ক। ভালো কাজটাই করতে চাই। সেটা হলে হবে, না হলে দরকার নেই। পাঠক, দর্শক বা শ্রোতার যেন মনে থাকে।
পিডিএসও/তাজ