বলরাম দাশ অনুপম, কক্সবাজার

  ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে বিরাট কর্মযজ্ঞ

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

মানবিক সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের অনুদান ও সহায়তায় স্থানীয় জনপদে ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন সেবা ও সুবিধা সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় অধিবাসী ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সেবা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা ইত্যাদি কার্যক্রম চলমান রেখেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।

উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রোহিঙ্গা জনজীবনের সেবা সুবিধা সহায়ক বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধিনে ‘জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় মাল্টি-সেক্টর প্রকল্প (ইএমসিআরপি)’ এর আওতায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি।

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাল্টিপারপাস কমিউনিটি এন্ড সার্ভিস সেন্টার ক্যাম্প-৪ এক্সটেনশন, ক্যাম্প-৫, ২০ এক্সটেনশন, ১৫, ১৭, ১৮, ১৯, ক্যাম্প-২০ ব্লক-এম-৮, ২০ ব্লক-এম-৩১ এবং ক্যাম্প ২ ডব্লিউ তে একাধিক কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও গভীর নলকূপ স্থাপন ও নিরাপদ পানি সরবরাহ, পয়ঃবজর্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্ল্যান্ট নির্মাণ, সৌরবিদ্যুৎ, বিভিন্ন সেবাকেন্দ্র নির্মাণ, জেটি নির্মাণ, রাবার ড্যাম স্থাপন, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণ ও পুনর্র্নিমাণ করেছে।

ক্যাম্প-১৯ এর মাঝি শামশুল আলম বলেন, ‘ আমরা আগে রাস্তাঘাটের অভাবে চলাফেরা করতে খুবই কষ্ট পেয়েছি। অসুস্থ ও গর্ভবতী নারীদের নিয়ে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারিনি। কিন্তু বর্তমানে অনেক সুন্দর রাস্তা পেয়েছি। খুব সহজে হাট বাজার ও হাসপাতালে যাতায়ত করতে পারি। এলজিইডির এই সহায়তা প্রশংসা করার মতো।

একই ক্যাম্পের বাসিন্দা হাবিব হোসেন বলেন, ‘ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য আমাদের আশ্রয়ণ কেন্দ্র দরকার। সেই সমস্যার কথা ভেবে এলজিইডি আমাদের ক্যাম্পে বড় আশ্রয়ণ কেন্দ্র নির্মাণ করে দিচ্ছে। এই আশ্রয়ণ কেন্দ্র আমাদের জন্য অনেক ভালো হবে। কোনো দুর্যোগ হলে আমরা সেখানে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিতে পারবো।’

শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্প নয়, স্থানীয়ভাবেও অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়েছে। উখিয়া উপজেলার দরগাহ বিল, দরগাহ পালং, টাইপালং, ডেইলপাড়া, হাতিমুড়া, লম্বাঘোনা, শৈলডেবা, ডিগলিয়া পালং, ডেইল পাড়া, চাকবৈঠা, গয়াল মারা, আমতলী, ভালুকিয়া, তুলাতুলিসহ আরো অনেক এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা যাতায়াতের জন্য ব্রিজ, কালভার্ট, আশ্রয়ণ কেন্দ্র ও মনোরম টেকসই সড়ক করে দেওয়া হয়েছে।

চাকবৈঠা এলাকার মো. আয়ুবুল ইসলাম বলেন, ‘ এলজিইডি মানুষের যাতায়াতের জন্য যে সমস্ত সড়ক, ব্রিজ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে আশ্রয়ণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে তা এলাকাবাসীর জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। উখিয়ার টাইপালং হয়ে দরগাহ বিল ও দরগাহ পালংয়ের মাঝামাঝি যে ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে সেই ব্রিজের সুবিধা শুধু উখিয়া উপজেলার মানুষ নয়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অনেক মানুষও সুবিধা ভোগ করছেন। তারা শান্তিপূর্ণভাবে যাতায়াত করতে পারছেন। এসব অবকাঠামো নিশ্চয় স্থানীয় জনসাধারণের জন্য অত্যন্ত উপকার হয়েছে।'

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী প্রতিপদ দেওয়ান বলেন, 'কক্সবাজারে ৩৩টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৫টি প্যাকেজ বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি ২৮টি প্যাকেজের কাজও শেষ পর্যায়ে। স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের কথা চিন্তা করে ক্যাম্পে এবং ক্যাম্পের বাইরে যথেষ্ট কাজ করছে এলজিইডি। রাস্তা, ব্রীজ, কালভার্ট থেকে শুরু করে আশ্রয়ণ কেন্দ্রসহ নানান ধরণের অবকাঠামোর সুবিধা ভোগ করছে স্থানীয়সহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এসব সম্ভব হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ডিডিসিএল ফিল্ড রেসিডেন্স ইঞ্জিনিয়ার মো. শফিকুল কবীর বলেন, ‘স্থানীয় অধিবাসী এবং ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রাস্তা, ব্রিজ, আশ্রয়ণকেন্দ্র, কালভার্ট, সড়কবাতি, সৌরবিদ্যুৎ সহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে অনেক খুশি। স্থানীয়রা এবং রোহিঙ্গারা যাতায়াতের জন্য ৩টা প্যাকেজে কাজ করছি আমরা। প্যাকেজগুলো হলো- ডব্লিউ-৮, ডব্লিউ-১৪ এবং ডব্লিউ-১৫। এছাড়া এলজিইডি সাড়ে ৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করেছে। ৪২ মিটার ও ৪৮ মিটারের ২টি ব্রিজ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালকের নির্দেশে আমরা স্থানীয় এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে কাজগুলো করেছি তা অত্যন্ত কোয়ালিটিপূর্ণ। কক্সবাজার এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলীর পরিচালনায় উপজেলা প্রকৌশলী, কনসালটেন্ট প্রকৌশলীসহ আমরা একত্রে টিম ভিত্তিক কাজ করেছি যাতে কাজগুলো টেকসই ও মজবুত হয়। ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ নানা সুবিধার সুফল ভোগ করতে পেরে স্থানীয় এবং রোহিঙ্গারা অত্যন্ত উপকৃত হয়েছে বলে ইতিবাচক সাড়া প্রদান করেছে।’

এদিকে ইএমসিআরপি প্রকল্প কর্তৃক গৃহীত সেবা সুবিধা সহায়ক নির্মিত অবকাঠামোগুলো হলো- বিদ্যালয় কাম দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ৫০টি, বহুমুখী কমিউনিটি ও সার্ভিস সেন্টার নির্মাণ ৩৪টি, রাস্তার উন্নয়ন ২৩৭.৩৮ কিমি, মাঠ পর্যায়ের অফিসের সংস্কার সহ সম্প্রসারণ ১টি, রাস্তা মজবুত ও প্রশস্তকরণ ৪২.১৫ কিমি, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ফুটপাথ, ড্রেনেজ সুবিধা নির্মাণ এবং পার্শ্ব- ঢাল সুরক্ষা ২.৫ কিমি, আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ ৩৭১ মি, রাস্তার পাশের ড্রেন নির্মাণ ২০০০ মি, হাট বাজারের উন্নযন ৬টি, ত্রাণ প্রশাসন ও বিতরণ কেন্দ্র নির্মাণ ১টি, সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন ৪০০০টি, বজ্র নিরোধক সুরক্ষা সিস্টেম সরবরাহ এবং স্থাপন ৯৭৫টি, বিভিন্ন রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ ২০ কিমি, রাবার ড্যাম নির্মাণ এবং উন্নয়ন ২৬৫ মি, জেটি উন্নয়ন ১৫৫০ মি, সোলার পিডি ন্যানো গ্রিড সরবরাহ ও স্থাপন ১০০টি, উখিয়া ও টেকনাফে বিদ্যমান ফায়ার সার্ভিস অফিসের উন্নয়ন ২টি, কক্সবাজারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের জন্য ভবন নির্মাণ ১টি, কক্সবাজারে এলজিইডি ভবনের উন্নয়ন ১টি, কক্সবাজারে এলজিইডির জন্য প্রশিক্ষণ সুবিধা নির্মাণ ১টি।

স্থানীয় ও রোহিঙ্গা জনজীবনের সেবা সুবিধা নিশ্চিত ও ফলপ্রসূ করতে অবকাঠামোগুলোর সুষ্ঠু ব্যবহার ও যত্নের বিষয়টিকে ইএমসিআরপি প্রকল্পে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রামস্ (বিসিসিপি) এই প্রকল্পের কমিউনিকেশন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়মিত কমিউনিটি ভিত্তিক নানান কার্যক্রম পরিচালিত করছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কক্সবাজার,রোহিঙ্গা,বিশ্বব্যাংক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close