আশরাফুল ইসলাম, শ্রীপুর (গাজীপুর)

  ২০ ডিসেম্বর, ২০২২

স্বজনদের আক্ষেপ

শ্রীপুরের শহীদ পরিবারের খবর কেউ রাখে না 

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা বরমী ইউনিয়নের সাতখামাইর গ্রামের শহীদ আবদুস সাত্তারের স্ত্রী হারেছা খাতুন। বয়সের ভারে এখন নুয়ে পড়েছেন হারেছা। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছিলেন তার স্বামী আবদুস সাত্তার। স্বাধীনতার ৫১ বছরেও শহীদের স্বীকৃতি পায়নি তার পরিবার। স্বামীর কথা জানতে চাইলে আঁতকে ওঠেন তিনি। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, শেখ মুজিব নেই, আমাদের খবর কে রাখবে? বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর করা চিঠি দেখিয়ে বলেন, তিনি শহীদ পরিবারকে ২ হাজার করে টাকা দিয়েছিলেন। ঘর করতে দিয়েছিলেন টিন। সেই টিনের ঘরে এখনো থাকি।

শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর আমাদের খবর কেউ রাখে না। আমাদের পরিবারের ভাগ্যে জোটেনি সামান্য স্বীকৃতি। মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবারের মতো আমরাও স্বজন হারিয়েছি। নির্যাতিত হয়ে ক্ষতির শিকার হয়েছি। মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবারগুলো স্বীকৃতির পাশাপাশি পাচ্ছে সরকারি সুযোগ-সুবিধা। আমরা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার কাছে স্বীকৃতি চাই।

ওই সময় উপজেলার বরমী ইউনিয়নের সাতখামাইর গ্রামে শুধু হারেছার স্বামী আবদুস সাত্তার নয়, একে একে শহীদ হয়েছিলেন আরো ১১ জন। অন্য শহীদরা হলেন ওই গ্রামের আবদুল বাতেন, মুনসুর আলী, ইছব আলী, কান্দু মুন্সি, ইসমাইল হোসেন, সুনাব আলী ওরফে সুনা পাগলা, আবদুল লতিফ, আতর আলী, হানিফ মিয়া, সালেহা বেগম ও রুকিয়া বেগম শিরিন। এছাড়া একইভাবে শহীদ হয়েছিলেন কেওয়া গ্রামের মো. সাদির আকন্দ ও মো. আলমগীর বাদশা আকন্দ। স্বজনদের অভিযোগ, স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও এই গণশহীদের স্বীকৃতি মেলেনি। স্বজনরা ওই শহীদদের স্বীকৃতি দাবি করেন।

বয়োবৃদ্ধ হারেছা আরো বলেন, চারদিকে ছিল যুদ্ধ। রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে গ্রামের মানুষ বনবাদাড়ে লুকিয়ে থাকত। সেদিন ছিল বুধবার। কয়েকদিন লুকিয়ে থেকে স্বামী-সন্তান নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। মধ্যরাতে স্থানীয় দুই রাজাকার পাকসেনাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। তার স্বামীকে ঘর থেকে ধরে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। ভয়ে পাঁচ সন্তান নিয়ে পালিয়ে যান হারেছা। পরদিন শুনতে পান তার স্বামীর সঙ্গে একই পরিণতি হয়েছে গ্রামের আরো ৬ জনের। গ্রামের লাল্লাবাগ নামক স্থানে পড়ে আছে সাত শহীদের নিথর দেহ। হানাদার বাহিনী ওই সময় সাতখামাইর গ্রামে সব মিলিয়ে ১২ জনকে হত্যা করেছিল।

শহীদ আতর আলীর নাতি সজিব বলেন, তখন তার জন্ম হয়নি। বাবা-মায়ের কাছে দাদার কথা শুনেছেন। অনেক শহীদের স্বীকৃতি মিলেছে। পাচ্ছেন সরকারি সুবিধা। তাদের নামে রাস্তাও হয়েছে। তার দাদা গণহত্যার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন। অন্যদের মতো তার পরিবারও ক্ষতির শিকার হয়েছিল। গ্রামে একটি স্মৃতিসৌধ বানিয়ে তাতে শহীদদের নাম লেখা আছে মাত্র। ভাগ্যে জোটেনি শহীদের স্বীকৃতি। তাদের নামে লাগেনি কোনো রাস্তার নামফলক। তিনি গণহত্যার শিকার শহীদদের স্বীকৃতি দাবি করেন।

আলমগীর বাদশা আকন্দের ছেলে মো. লুকমান আকন্দ বলেন, তার ভাই নজরুল ইসলাম আকন্দ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। সেজন্য রাজাকার আর পাকসেনারা তার বাবাকে কেওয়া গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। বাবার লাশটিও পাননি। তিনি শহীদদের স্বীকৃতি দাবি করেন। শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো. মতিউর রহমান বলেন, ওনারা গণহত্যার শিকার। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে ২ হাজার করে টাকা দিয়েছিলেন। গণশহীদের কোনো তালিকা নেই।

শ্রীপুরের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, যুদ্ধ করে যারা শহীদ হয়েছেন, তারাই কেবল শহীদের স্বীকৃতি পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ফকির বলেন, ওই শহীদদের তালিকা আছে। খুব সহসাই মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভায় ওই শহীদদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মুক্তিযুদ্ধ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close