মো. রবিউল ইসলাম, টঙ্গী (গাজীপুর)

  ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ট্রেন আসার কয়েক মুহূর্ত আগে দৌড়াদৌড়ি করে বন্ধ করা হয় লেভেলক্রসিংয়ের গেট

ট্রেন আসার সংকেত থাকে না গেটম্যানের কাছে

গাজীপুরের টঙ্গীর বনমালা লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যানের সতর্ক অবস্থান। ছবি শনিবার তোলা-মো. রবিউল ইসলাম

লাল সবুজ দুটি পতাকা হাতে হরহামেশাই রেলগেটে দেখা মেলে এক ব্যক্তির। ট্রেন আসার কয়েক মুহূর্ত আগে সেই ব্যক্তি দৌড়াদৌড়ি করে বন্ধ করে দেন লেভেলক্রসিংয়ের গেট। তাদের বলা হয় গেটম্যান। কিন্তু লাল আর সবুজ রঙের দুটি পতাকা হাতে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের মধ্যেও তাড়া দাঁড়িয়ে থাকেন রেললাইনের ওপর।

গাজীপুরের টঙ্গীর বনমালা রেলগেট এলাকায় লেভেলক্রসিংয়ের গেটম্যান শহিদুল ইসলামের নিত্যদিনের কাজ এটি। তার ভাষ্য মতে এই লেভেলক্রসিংয়ের সিগন্যাল বেল স্থাপনের পর থেকেই অকেজো। আর সিগন্যাল বাতিগুলো অনেক সময় ট্রেন আসার সিগন্যাল দিতে সক্ষম হয় আবার অনেক সময় সক্ষম হয় না। এতে দুর্ঘটনা রোধ করতে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের মধ্যেও ট্রেন আসার খবর রাখতে হয় রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে। কিন্তু তবু ঘটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।

শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে টঙ্গীর আরিচপুর বৌবাজার রেলগেটে ট্রেন আসার কোনো ধরনের সিগন্যাল না থাকায় ও রেলগেট এলাকায় রোড ব্লকার না থাকায় সাধারণভাবেই যাতায়াত করতে থাকে যানবাহন। চলে আসে ট্রেন। ট্রেন কাছে চলে আসায় রেললাইনের ওপরই অটোরিকশা ফেলে তড়িঘড়ি নেমে পড়েন চালক ও এর যাত্রীরা। অল্পের জন্য যাত্রী ও চালক বেঁচে যান। দুমড়ে-মুচড়ে যায় অটোরিকশাটি।

এর আগে গত ১৯ জুন বউবাজার রেলগেট এলাকা থেকে রাত পৌনে ১১টার দিকে টঙ্গী থেকে একটি অটোরিকশাকে ঠেলে উত্তরার আবদুল্লাহপুরের কোটবাড়ি রেলগেটে নিয়ে যায় ঢাকাগামী একটি ট্রেন। সে ঘটনায় ওই অটোরিকশার চালক মো. মোতালেব (৪৫) গুরুতর আহত হয়েছেন। তার কয়েক মাস আগে ২২ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে টঙ্গী পূর্ব থানাধীন মধুমিতা লেভেলক্রসিংয়ে অটোরিকশা যাত্রীসহ পার হওয়ার সময় ঢাকা থেকে জয়দেবপুরগামী তুরাগ ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। সে সময় অটোরিকশা যাত্রী নুরে আলম নোমান (৮) নিহত হয়েছেন। এ দুর্ঘটনায় অটোরিকশাটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং অটোরিকশার চালক মফিজুল ইসলাম (৩০), আবদুল হাকিম (৩০) নাজমুল ইসলাম (১৬), অজ্ঞাত পুরুষ বয়স অনুমান (৪০) ৪ জন গুরুতর আহত হন।

গেটম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যানদের জন্য স্থাপন করা হয়েছে গেটম্যান রুম। কিন্তু সেই রুমে নেই কোনো টয়লেট, নেই ট্রেন আসা-যাওয়ার সংবাদ পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা। তাই বাধ্য হয়ে ট্রেন আসা-যাওয়ার খবর রাখতে লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয় গেটম্যানদের। টানা ৮ ঘণ্টা ডিউটির ৮ ঘণ্টায়ই এই রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় গেট। তবে বিপত্তি বাধে তখনই যখন প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে হয়। অনেক সময় স্থানীয় কাউকে রেললাইনের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে যেতে হয়।

একই অবস্থা এখানে কর্মরত অন্য গেটম্যানদের। আর দুর্ঘটনা তখনই ঘটে অনেক সময় ট্রেন দূর থেকে হুইসেল না দিয়েই চলে আসে। ট্রেন আসা-যাওয়ার আগাম খবর না থাকায় ঘটে দুর্ঘটনা।

একই দৃশ্য দেখা মেলে টঙ্গীর আরিচপুর বউবাজার রেলগেট, টঙ্গী মধুমিতার রেলগেট, টঙ্গী স্টেশন রোড রেলগেট, প্রয়াত এমপি শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের বাসভবনের রেলগেট, সামন্তপুরসহ বেশ কিছু রেলগেটে। টঙ্গী আরিচপুর বউবাজার এলাকার বাসিন্দা লিটন উদ্দিন সরকার বলেন, টঙ্গী বউবাজারের রেলগেটের জন্য লাখো মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অল্পতেই অটোরিকশার যাত্রী ও চালক লাফ দিয়ে বেঁচে যান। আমিও ছিলাম পেছনে। বউবাজারের এ ধরনের ঘটনা বিভিন্ন সময় মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তুকোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আমাদের দেশের রেলের যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে সেই তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। আমরা যদি বাস্তবতা একটু চিন্তা করি তাহলে দেখব, রেল দুর্ঘটনা পাশের কিংবা অন্যান্য তুলনায় বউবাজারে অনেক বেশি ঘটে। যত দিন লেভেলক্রসিংয়ে গেট দেওয়া না হবে, তত দিন এ সমস্যা বিদ্যমান থাকবে।

বনমালা রেলগেট এলাকার বাসিন্দা শারমিন আক্তার বলেন, রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেই যদি ট্রেনের খবর রাখতে হয় তাহলে কী লাভ এত উন্নত যন্ত্র স্থাপন করে। গেটম্যানদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি আর রেলপথ নিরাপদ করতে সিগন্যাল বেইল ও বাতি দ্রুত প্রতিস্থাপন করে আধুনিকায়ন করা জরুরি। নয়তো এমন মৃত্যু বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বদলির কারণ দেখিয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. রাকিবুর রহমান বলেন, রেলওয়ে গেটগুলো দেখভাল, সিগন্যাল প্রদান ও গেটম্যান নিয়ন্ত্রণ সব কার্যক্রম উপসহকারী প্রকৌশলীর দায়িত্বে। রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার বা সংশ্লিষ্ট কারো কোনো দায়িত্ব নেই।

উল্লেখ্য, গত ২৯ জুলাই শুক্রবার চট্টগ্রামের মীরসরাই লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ শিক্ষার্থীর নিহত ঘটনা ঘটে। এর ঠিক পাঁচ দিন আগে গাজীপুরের শ্রীপুর লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেলের ধাক্কায় প্রাণ যায় ৪ শ্রমিকসহ ৫ জনের। তার ৩ দিন আগে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী কাগদি লেভেলক্রসিংয়ে ভটভটি ট্রেনের নিচে চলে গেলে নিহত হন ৫ জন শ্রমিক। কয়েক দিনের ব্যবধানে লেভেলক্রসিংয়ে ২১ জনের মৃত্যু হয়। আর সেভ দ্য রোডের তথ্য মতে, চলতি বছরে রেলপথে ১ হাজার ৫২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৭৮ জন এবং আহত হয়েছেন ১১৭০ জন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গেটম্যান,রেল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close