গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

সন্দেহভাজন ব্যক্তি জামিনে মুক্ত, ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় পরিবার

চারঘাটে মান্নান হত্যা, পিবিআই তদন্তেও অগ্রগতি নেই

ফাইল ছবি

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার শলুয়া ইউনিয়নের কানুজগাজী গ্রামের পল্লী চিকিৎসক আবদুল মান্নান (৭০)। গত ২২ এপ্রিল তাকে নির্মমভাবে গলাকেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। এ হত্যার সাড়ে চার মাস পরও হত্যা রহস্যের ‘ক্লু’ খুঁজে পায়নি পুলিশ। এ নিয়ে ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছেন স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তারাও। বলেন, এ মামলাটির ডকেটসহ সব নথি অন্য সংস্থায় হস্তান্তর হয়েছে; তাদের কাছে কিছু নেই। এরই মধ্যে মামলার সন্দেহভাজন প্রধান আসামি জামিনে মুক্ত রয়েছে। এ নিয়ে নিহতের পরিবারে বিরাজ করছে আতঙ্ক। দীর্ঘদিনেও নিহতের হত্যাকারীতে শনাক্ত করতে না পারায় ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলাটির তদন্তে কাজ করছে। নিহতের পরিবারের দাবি, মামলাটি আমলে নেওয়ার পর সংস্থাটি একবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তবে, পিবিআই বলছে, মামলাটির কার্যক্রম থেমে নেই। নিয়মিত ফলোআপ হচ্ছে। আর বাদীকে অবহিত করে মামলাটি অনুসন্ধান কাজ চালাতে হবে, এমন কোনো বিধান নেই। মামলার বাদী জানান, এখন পর্যন্ত মামলার যে তদন্ত অগ্রগতি তাতে আমি সন্তুষ্ট না। বলেন, যাকে প্রধান আসামি করে মামলা রুজু করেছিলাম, সে এখন জামিনে মুক্ত। নির্বিঘেœ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া কষ্টের। দেখা যাক, হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে। এখন পিবিআইর তদন্তে কি বেরিয়ে আসে, সে অপেক্ষায় আছি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত আবদুল মান্নান পেশায় একজন পল্লী চিকিৎসক ও ওষুধ ব্যবসায়ী। উপজেলার শলুয়া ইউনিয়নের মালেকার মোড়ে তার একটি ওষুধের দোকান রয়েছে। এছাড়া কানুজগাড়ী নিজ বাড়ির অদূরে নিহত আবদুল মান্নান একটি কলাবাগান ও বেগুনের জমি রয়েছে। কিছুদিন পর পর কলা ও বেগুনে পোকা দমনের জন্য সেখানে মাঝে মধ্যে কীটনাশক প্রয়োগ করতে জমিতে যেতেন। ঘটনার দিন গত ২২ এপ্রিল ইফতারের আগে নিজ বাড়ি থেকে ইফতারসামগ্রী নিয়ে নিজ ফসলি জমিতে যান মান্নান। এর পর সন্ধ্যা গড়িয়ে এশার নামাজের সময় পেরিয়ে গেলেও বাড়িতে ফিরে না আসায় পরিবারের লোকজন তাকে খুঁজতে বের হন। পরে রাত ৮টার দিকে তার নিজ জমির বেগুনখেতে একটি গর্তের মধ্য থেকে তার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, পল্লী চিকিৎসক মান্নানকে কেউ হত্যা করতে পারে, এটা আমরা এখনো বিশ্বাস করতে পারি না। কারণ তিনি ছিলেন, নিরীহ, পরোপরকারী ও শত্রুমুক্ত মানুষ। ছোট-বড় সবাইর সঙ্গে মিশতেন বন্ধুসুলভ। নিজ কৃষি জমিতে ওষুধ ছিটাতে গিয়ে না ফিরে আসার ঘটনাটি রহস্যজনক। কে বা কারা হত্যা হয়েছে সেখানে ফেলে রেখেছিল, সেটাও রহস্যের আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে। আমরা চাই, মান্নান হত্যা বিচারটির রহস্য উন্মোচিত হোক। ন্যায়বিচার পাক পরিবার।

শলুয়া ইউপির ৭ং ওয়ার্ডের মেম্বার সাবদুল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, পল্লী চিকিৎসক মান্নান সৎ ও সজ্জন। তার কোনো শত্রু নেই। আমি নিজেই ভেবে পাই না এমন মানুষকে কে হত্যা করতে পারে। আমি ন্যায়বিচার চাই। প্রকৃত অপরাধী যাতে ধরা পড়েন, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হওয়ার অনুরোধ জানাই।

নিহতের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা জানান, আবদুল মান্নান পারতপক্ষে কারো সঙ্গে বিরোধে জড়াতেন না। মানুষের সেবা করেই দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় কাটাতেন। কেউ তাকে হত্যা করতে পারে, এমন শত্রু ছিল না।

তবে নিহত হওয়ার আগে তিনটি ঘটনা বড় দাগে আমলে নেয়া যায় বলে জানান তারা। এক. প্রতিবেশী রবিউল নামে একজন মাদক কারবারির সঙ্গে বিদ্যুতের পিলার বসানো নিয়ে তুচ্ছ বিরোধ এবং দ্বিতীয়টি মাদক ব্যবসায়ীদের মাদক থেকে ফেরাতে তৎপরতা দেখানো। এ ছাড়া তৃতীয়ত, পল্লী এই চিকিৎসককে নৃশংস্যভাবে হত্যার কয়েক দিন আগে মামলার প্রধান আসামি রবিউল ইসলাম কানুজগাড়ী মোড়ে আবদুল মান্নানের সঙ্গে দেখা হয়। এ সময় তাকে উদ্দেশে করে রবিউল বলেছিল, আর কয়দিন খাবি খেয়ে নে, তুই আমাকে বিদ্যুতের সংযোগ নিতে দিসনি; তোর সময় শেষ হয়ে আসছে। রবিউল যখন এই ঔদ্ধত্যমূলক কথাগুলো বলছিলেন, পাশেই থাকা সবজি বিক্রেতা আরেজুল্লা শুনেছিলেন, যা পরে নিহতের পরিবারকে ওই সবজি বিক্রেতা জানিয়েছিলেন বলেও পরিবারের পক্ষ থেকে এ প্রতিবেদককে জানায়।

নিহতের ছেলে ও মামলার বাদী মাহিম লিমন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আব্বার হত্যার জন্য দায়ী প্রতিবেশী আবদুর রশিদের ছেলে রবিউল ইসলাম। হত্যার কয়েক দিন আগে, আমাদের জমির ওপর দিয়ে ও বাড়ির বিদ্যুতের পোল থেকে লাইন টেনে সংযোগ নিতে চেয়েছিল রবিউল। আমাদের অসুবিধা হবে, তাই আব্বা ও চাচা বাধা দেন।

এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় ও চারঘাট থানার ঝিকড়া গ্রামের সাবেক মেম্বার বুদি আমার ছোট ভাই লিপনকে ফোন করে হুমকি দেয়। এর পরদিন সন্ধ্যায় বাড়ির পাশের ফসলি জমিতে ওষুধ ছিটাতে গিয়ে নির্মম হত্যার শিকার হন তিনি। অথচ আব্বা নিজ চেম্বারে না গিয়ে ২২ এপ্রিল মাঠে ওষুধ ছিটাতে যান সেটা রবিউলের পরিবার ছাড়া কারো জানার কথা না।

বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া নিয়ে বিরোধ ও মাদক বিক্রেতাদের তাদের কাজে বাধা দেওয়া- এ দুটিই আব্বার মৃত্যুর কারণ। কারণ এই রবিউল ও তার শ্বশুরবাড়ির বেশির ভাগ মানুষ মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত।

লিমন আরো বলেন, আব্বার নিহত হওয়ার খবর শোনার পর এই রবিউল ও তার পরিবার ছাড়া সবাই ছুটে আসেন। এ ঘটনায় ডিবি পুলিশের জেরার মুখে পড়লেও ধূর্ত রবিউল সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন বারবার। এখন জামিনে মুক্ত হয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দীর্ঘ সাড়ে ৪ মাসেও পুলিশ প্রশাসন আব্বা হত্যার কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। এখন আমরা পুরো পরিবার এবং এলাকাবাসী চরম আতঙ্কের মধ্যে দিনতিপাত করছি। আমরা চাই, অতি দ্রুত প্রকৃত খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসবেন।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের বড় ছেলে মাহিম হোসেন লিমন বাদী হয়ে চারঘাট মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। পরে ঘটনার ওই রাতেই এজাহারনামীয় আসামি ঐ এলাকার আবদুর রশিদের ছেলে রবিউল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয় একই গ্রামের আবদুর রাজ্জাক আলীর ছেলে লিটন আলীকে। পরে দুজনকেই ঘটনার পরের দিন শনিবার দুপুরের দিকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ এজাহারনামীয় আসামি রবিউল ইসলামকে তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি।

পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, হত্যা রহস্যটি উদঘাটনে সব ধরনের তৎপরতা চালিয়েছিলাম। কিন্তু হত্যা রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারেনি। সে অর্থে আমরা ব্যর্থ হয়েছি বলতে পারেন। তবে, বর্তমানে মামলাটি আমাদের কাছে নেই। অন্য সংস্থায় হস্তান্তর হয়েছে। আমাদের কাছে থাকা সব ধরনের তথ্য ওই সংস্থাকে সরবরাহ করেছি।

পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা এএসআই খায়রুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, মামলাটি নিয়ে নিয়মিত ফলোআপ করছি। তদন্তে কোনো গাফিলতি নেই। ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা এটি তদারকি করছেন। বিস্তারিত জানতে চাইলে টেলিফোনে না, অফিসে এসে কথা বলেন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
হত্যা,রাজশাহী
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close