আরিফ খান, বেড়া (পাবনা)

  ১১ আগস্ট, ২০২২

বেড়ায় ডিগ্রি কলেজে অবৈধভাবে তিন বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

পাবনার বেড়া উপজেলার মাশুন্দিয়া ভবানীপুর কে জে বি ডিগ্রি কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক আব্দুস ছালাম বিশ্বাস প্রায় ৩ বছর ধরে বিধি বহির্ভূতভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি পরিচালনা পর্ষদের কাছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি গোপন করে অবৈধভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও দুর্নীতি দমন কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন ঐ কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আব্দুল মন্নাফ সরকার। লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ মো. আব্দুল গণি ২০১৭ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলে তাকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ২০১৮ সালে অর্থনীতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমানকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যায়ের বিধি মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারও মেয়াদ এক বছর পূর্ণ হলে বিধি অমান্য করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যায়ের অধিভূক্ত/স্বীকৃত বিষয়ের বাইরে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. আব্দুস ছালাম বিশ্বাসকে ২০১৯ সালে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পদার্থ বিজ্ঞান বিষয় অত্র কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত/স্বীকৃত বিষয় না হওয়ায় (শুধু উচ্চ মাধ্যমিকের অনুমোদিত বিষয়) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী তার দায়িত্ব পালন সম্পূর্ন অবৈধ।

‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক রেগুলেশন (সংশোধিত) ২০১৯’ এর ৪ (ক) এর ২ নং বিধি এবং সদ্য প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন স্মারক নং-০৭(১৫২৫) জাতীঃ বিঃ/কঃ পঃ ৫৪৬১৪ সূত্র নং-০৭ (১৫২৫) জাতীঃ বিঃ/কঃপঃ/বিবিধ-৫১৭৫১ মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ৬ (ছয়) মাসের বেশি, যুক্তি সংগত কারণে ১ (এক) বছরের মধ্যে নিয়মিত অধ্যক্ষ নিয়োগ দান করতে ব্যর্থ হলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের স্বাক্ষরকৃত কাগজপত্র ও কার্যবিবরণী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্বীকৃত অথবা গৃহীত হবে না। অথচ, অত্র কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তিন বছরের অধিক সময় কমিটির কতিপয় সদস্যের সহযোগিতায় বিধি বহির্ভূতভাবে দায়িত্ব পালন করায় তার স্বাক্ষরকৃত গত প্রায় তিন বছরের সমস্ত কার্যাবলী সম্পূর্ণ অবৈধ।

‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলী রেগুলেশন-এ স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় অধিভূক্ত কলেজে অধ্যক্ষ পদ শূন্য হলে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃক অধিভূক্ত/স্বীকৃত বিষয়সমূহের শিক্ষকদের মধ্য হতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। অত্র প্রতিষ্ঠানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অধিভূক্ত/স্বীকৃত বিষয়ের বেশ কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক কর্মরত থাকা সত্ত্বেও বিধি বহির্ভূতভাবে উচ্চ মাধ্যমিকের পঠিত বিষয়ের শিক্ষক মো. আব্দুস ছালাম বিশ্বাসকে কেন নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিয়ে তিন বছর বহাল রাখা হয়েছে, তা কারোরই বোধগম্য নয়।

এই কলেজে একাধিকবার অধ্যক্ষ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর যোগ্যতাসম্পন্ন বেশ কয়েকজন প্রার্থী আবেদন করলেও অধ্যক্ষ নিয়োগের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বরং প্রার্থীদের আবেদন গায়েব করে দেন অভিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। কোন আবেদনপত্র জমা পড়েনি বলে গভর্নিং বডির কাছে তিনি প্রচার করেন। বস্তুত আবেদনকারীরা নিয়োগ লাভের জন্য উপযুক্ত ডিমান্ড (ঘুষ/উৎকোচ) পূরণ করতে রাজি না হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুস ছালাম বিশ্বাস কোন নিয়োগ কমিটি গঠন না করে প্রার্থীদের আবেদন গায়েব করে দিচ্ছেন বলে কলেজর সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ করেছেন।

কলেজ গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি আব্দুল আজিজ খান এবং অন্যান্য সদস্যরা জনবল কাঠামো সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে অবগত না থাকায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুস ছালাম বিশ্বাস তাদের সাথে প্রতারণা করে অবৈধভাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন বলে জানান গভর্নিং বডির একজন সদস্য (তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি)। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী অধিভূক্ত/স্বীকৃত বিষয়ের সৎ ও নিষ্ঠাবান কয়েকজন শিক্ষক কলেজে থাকার পরেও প্রশাসক হিসেবে সম্পূর্ণ অযোগ্য আব্দুস ছালাম বিশ্বাসকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়ায় কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী-শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং এলাকার সুশীল সমাজ চরমভাবে মর্মাহত। অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৩ বছরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুস ছালাম বিশ্বাস (একটানা) দায়িত্ব পালন করেছেন। তার এই অপকর্ম ধামাচাপা দেবার জন্য সম্প্রতি গভর্নিং বডিকে ম্যানেজ করে ব্যাক ডেটে (পূর্বের তারিখ) কয়েকটি রেজুলেশন তৈরি করেছেন। নভেম্বর ২০২১ সালে একটি রেজুলেশনে ওই কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. হেদায়েত উল্লাহকে (দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ) ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান এবং পরবর্তী কয়েকদিন পরেই ১৯/১১/২০২১ তারিখে অসুস্থতার কারণ উল্লেখ করে তার অব্যাহতির আরেক রেজুলেশন লিখে রেখেছেন। অন্য আরেকটি রেজুলেশনে সম্প্রতি রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডিজি তৌহিদুজ্জামানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়ে ২০দিন পরে পুনরায় অব্যাহতির রেজুলেশন লিখে নেন। ওই দুইজনের কেউই একদিনের জন্যও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেননি। দুইজনই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুস ছালাম বিশ্বাসের ঘনিষ্ট বন্ধু। আইনের চোখে ধুলা দেবার জন্য কাগজে-কলমে এমন মিথ্যাচার করে তিনি নিজেকে জায়েজ করার জন্য এই রেজুলেশন তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রেজুলেশনে উল্লিখিত ওই তারিখগুলোতে কলেজের ইস্যুকৃত যে কোন কাগজপত্রের সীল-স্বাক্ষর ঘাটলেই এর সত্যতা মিলবে। আর তার এই কাজে বরাবরই সহায়তা করে চলেছেন গভর্নিং বডির কয়েকজন স্থানীয় সদস্য।

২০২১ সালের নভেম্বর মাসে কাগজে-কলমে রেজুলেশনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত জীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হেদায়েত উল্লাহ জানান, তিনি অসুস্থ ছিলেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ারেও বসেননি। তার দায়িত্ব কয়েকদিনের জন্য কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। তার কোন সীল-স্বাক্ষরও ব্যবহার হয়নি বলে এ প্রতিনিধির কাছে স্বীকার করেন। ২০২২ সালের মে মাসে কাগজে-কলমে-রেজুলেশনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ডিজি তৌহিদুজ্জামানকে। একাধিকবার বার মুঠোফোনে ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতির নিকট স্থানীয় নেতৃবর্গ মৌখিকভাবে অভিযোগ করলেও এখন পর্যন্ত তিনি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অভিযোগের সত্যতা যাচাইপূর্বক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুস সালাম বিশ্বাসকে দ্রুত এই পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিধিসম্মতভাবে স্থায়ীভাবে অধ্যক্ষ নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করে কলেজের সার্বিক শিক্ষার মান ফিরিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী ও এলাকাবাসী।

ঐ কলেজের গণিত বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক বিশ্বনাথ দত্ত প্রায় ৫ বছর আগে সপরিবারে ভারতে চলে যান। মাঝেমধ্যে তিনি ভারত থেকে দেশে এসে কলেজে হাজিরা দিয়ে যান। তবে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে গত প্রায় ১ বছরের অধিক সময় ধরে বিনা ছুটিতে ভারতে অবস্থান করায় তার স্বাক্ষর জাল করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুস ছালাম বিশ্বাস ও বিশ্বনাথ দত্তের ভাই সুনিল দত্তের যোগসাজসে নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন। এ নিয়ে গত সোমবার ৮ আগস্ট ‘ভারতে বসবাস, বাংলাদেশে চাকরি, কৌশলে বেতন’ শিরোনামে এই পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ,কলেজ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close