reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৯ নভেম্বর, ২০২২

পাঁচ বছরে মাংসের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি

ফাইল ছবি

প্রাণিজ আমিষের একটি বড় উৎস মাংস উৎপাদনে একসময় পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। এখন মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি করা হলেও দাম আকাশছোঁয়া। আগে প্রাপ্যতার অভাব থাকলেও এখন দামের কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে গরু, মহিষ কিংবা ছাগলের মাংস। পুষ্টির জোগানের সঙ্গে সম্পৃক্ত এ খাবারটি জনগোষ্ঠীর একটি অংশ নিতে না পারায় পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়ন বিঘ্নিত হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। মাংস ব্যবসায়ী সমিতি বলছে, সিন্ডিকেটের কারণে পেরে ওঠেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা।

গত পাঁচ বছরে মাংসের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বর্তমানে মাংসের দামকে অনেকে অতিরিক্ত বলেছেন। তারা বলছেন, সরকারের তদারকির অভাবে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে বাড়িয়েছেন মাংসের দাম।

খামারিরা বলছেন, দেশে পশুখাদ্যের অভাব রয়েছে। সেভাবে বাণিজ্যিকভাবে ঘাস উৎপাদন হয় না। আমদানিনির্ভর পশুখাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়ায় মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। প্রান্তিক পর্যায়ে পরিবারভিত্তিক পশু পালন কমে যাওয়া এবং খামারভিত্তিক ব্যবস্থায় মাংসের দাম এত বেড়ে গেছে। গরুর হাটগুলোতে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ও মাংসের দাম বাড়ার কারণ বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকারের নানা উদ্যোগের কারণেই মাংস উৎপাদনে আজ বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। এরই মধ্যে সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আধুনিক জবাইখানা নির্মাণ, উন্নতমানের ঘাস উৎপাদনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকার ‘প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধ উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্প’ নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মাংসের দামে এর সুফল পাওয়া যাবে।

ঘাটতি থেকে মাংসের উদ্বৃত্ত উৎপাদন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, একজন মানুষের দৈনিক মাংসের চাহিদা ১২০ গ্রাম। মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৭ লাখ ধরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী বছরে দেশে মাংস ও দুধের চাহিদা ৭৫ লাখ ২০ হাজার টন। সেখানে সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৯২ লাখ ৬৫ হাজার টন। যদিও মাংসের উৎপাদন ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ছিল ১০ লাখ ৪০ হাজার টন। দেশে এখন বছরে ১৭ লাখ ৪৫ হাজার টনের বেশি মাংস উৎপাদিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের শিশুদের মধ্যে খর্বকায় ২৮ শতাংশ, শীর্ণকায় ১০ শতাংশ আর স্বল্প ওজনের ২৩ শতাংশ। তবে চা বাগানে এ হার দ্বিগুণ।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ও ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, উচ্চমাত্রার অপুষ্টির ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের ৩৬টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ৫১ শতাংশ শিশু রক্তস্বল্পতায় (এনিমিয়া) ভুগছে। মায়েদের ক্ষেত্রে এ হার ৪২ শতাংশ।

এক যুগে প্রতি বছরই বেড়েছে মাংসের উৎপাদন। ২০০৬-০৭ ও ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন ছিল ১০ লাখ ৪০ হাজার টন করে। এর পরের বছর উৎপাদন ৪০ হাজার টন বাড়ে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মাংস উৎপাদিত হয় ১২ লাখ ৬০ হাজার টন। উৎপাদন ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৯ লাখ ৯০ হাজার টন, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৬ লাখ ২০ হাজার টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৫ লাখ ২১ হাজার ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫৮ লাখ ৬০ হাজার টন।

এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ছয় বছরে মাংস উৎপাদিত হয়েছে যথাক্রমে ৬১ লাখ ৫২ হাজার টন, ৭১ লাখ ৫৪ হাজার টন, ৭২ লাখ ৬ হাজার টন, ৭৫ লাখ ১৪ হাজার টন, ৭৬ লাখ ৭৪ হাজার টন, ৮৪ লাখ ৪০ হাজার টন।

পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দাম : দেশে মাংসের উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দামও। মাংস এখনো সাধারণ মানুষের কেনার সামর্থ্য নেই।

সরকারি বাণিজ্য সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬৬০ থেকে ৭০০ টাকায়। এক বছর আগে যা ছিল ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। খাসির মাংস প্রতি কেজি ৮৫০ থেকে ৯৫০ টাকা।

১৯৯০ সালের দিকে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ৫০ টাকা। এ দামটি দীর্ঘদিন বহাল থাকে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ১৯৯৫ সালের দিকে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ৬০ টাকা। এরপর প্রতি কেজি গরুর মাংস ২০০১ সালে ৮০, ২০০৫ সালে ১০০ টাকা। এরপর ২০০৬ সালে দাম হয় ১৪০ টাকা, ২০০৭ সালে ১৭৬ টাকা, ২০০৮ সালে ১৯২ টাকা, ২০০৯ সালে ২১৮ এবং ২০১০ সালে হয় ২৪৭ টাকা।

২০১৪ সালেও ঢাকায় এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ৩০০ টাকা। ২০১৮ সালে ৫২৭ টাকায় ঠেকে দাম। ২০২১ সালের অক্টোবরে গরুর মাংসের গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৫০ টাকা। ২০২২ সালের মার্চ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি গরুর মাংস।

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘এরই মধ্যে অন্যান্য অনেক জিনিসের মতো গরুর মাংসের দামও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। সমস্যা হলো সার্বিক মূল্যস্ফীতি। অন্যদিকে সবাই লাভ বেশি করতে চায়, সেটা হলো লোভস্ফীতি। যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে তাদের লোভ বেড়ে যাওয়ায় লোভস্ফীতি ঘটছে।’

খামারিরা মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য ঊর্ধ্বমুখী উৎপাদন ব্যয়কে দায়ী করছেন। আর উৎপাদন ব্যয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে গো-খাদ্য। এক্ষেত্রে নীতিগত সহায়তা চেয়েছেন খামারিরা।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ‘উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। বিশ্বে সবকিছুর দাম বেড়েছে। আমাদের গো-খাদ্যের দামও বেড়েছে। মূলত এজন্যই মাংসের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আমাদের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে গরুর মাংস ব্যবসায়ীদের হাতে আসার আগে দুটো হাট ঘুরে আসে। মফস্বলের ব্যাপারীরা গেরস্তের কাছে গিয়ে গরু কিনে নিয়ে আসেন। সেটা হাটে তোলেন। সেই লোকাল হাট থেকে আবার ঢাকার ব্যাপারীরা কিনে শহরের হাটে তোলেন। শহরের হাট থেকে কেনেন মাংসের ব্যবসায়ীরা।

ইমরান হোসেন বলেন, ‘দুটো হাটের যে খাজনা দিতে হয়, এটা কিন্তু অনেক বড় অঙ্ক। এক লাখ টাকার গরুতে দেখা গেছে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এটাও মাংসের দামে প্রভাব ফেলছে।’

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে পলিসি সাপোর্ট চেয়েছি। যাতে গরুর মাথাপিছু আয় সর্বোচ্চ হয়। সেক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ কমবে, এতে মাংসের দামও কমবে। এখন আমরা একটি দেশি গরু থেকে দেড়শ কেজি মাংস পাই, সেখানে যদি প্রতি গরু থেকে ৩০০ কেজি মাংস পাই এমন কোনো জাত দেওয়া হয় তাহলে খরচ কমানো সম্ভব। গো-খাদ্য আমদানির শুল্ক কমিয়েও সরকার আমাদের উৎপাদন খরচ কমাতে সহায়তা করতে পারে।’

ইমরান হোসেন বলেন, ‘হাটে যে অতিরিক্ত খাজনা দিতে হয়, এটা এড়ানো যায়। সেক্ষেত্রে আমরা সরকারের কাছে নীতিসহায়তা চাইছি। সরকার এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি। মাংসের দাম কমে যেতে বাধ্য।’

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাংস
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close