প্রকাশ ঘোষ বিধান

  ২২ অক্টোবর, ২০২৪

মুক্তমত

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। প্রতি বছর ২২ অক্টোবর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করে সরকার। ২০১৭ সাল থেকে নানা আয়োজনে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। সড়ক নিরাপত্তা কার্যক্রম টেকসই করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর সারা দেশে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়।

১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীকে হারানোর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। নিরাপদ সড়ক চাই শীর্ষক ওই আন্দোলন আরো গতি পেয়েছিল ২০১১ সালে ১৩ অগাস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীরের মৃত্যুতে। এরপর ২০১৭ সালের ৫ জুন মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর মধ্যেই ২০১৮ সালে ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দুই কলেজ শিক্ষার্থী বাসের ধাক্কায় মারা যাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছিল দেশ। পরে ৬ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভা একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করে, যে আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে কারো মৃত্যু ঘটালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।

প্রতিদিন সড়কে ঝরছে প্রাণ। খবরের কাগজে ভেসে উঠছে বীভৎস লাশের ছবি। নিহতের স্বজনদের চিৎকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করলেও তা যেন আমাদের বিবেককে নাড়া দিতে পারছে না। পরিবারের যে মানুষটি ছিল একমাত্র অবলম্বন, একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুতে পরিবারের অন্য সদস্যদের সব স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার উঁচু। গত ১০ বছরে সড়কে প্রতিদিন গড়ে মারা গেছেন ১৪ জন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শতকরা ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বিরামহীন গাড়ি চালনা, অত্যধিক গতিতে গাড়ি চালনা এবং চালকের অসাবধানতার কারণে। একজন চালক একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় গাড়ি চালাবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু দেশের কোনো চালকই এ নিয়ম পালন করেন না। ফলে একজন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত চালক যখন গাড়ি চালান, তখন স্বভাবতই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে বেশি। এজন্য মূলত বাস মালিকদের অত্যধিক ব্যবসায়িক মনোভাবই দায়ী। এ প্রবণতা রোধে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

জনগণের দীর্ঘদিনের দাবিতে দুর্ঘটনা রোধে একটি সময়োপযোগী সড়ক পরিবহর আইন হয়েছে। কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির নজির নেই। সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ-সংক্রান্ত কমিটি ১১১টি সুপারিশ করেছিল। নির্দেশনাগুলো হলো, দূরপাল্লার গাড়িতে বিকল্প চালক রাখা, একজন চালকের পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানো, চালক ও তার সহকারীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করা, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

দেশের উন্নত যোগাযোগ অবকাঠামো এবং যুগোপযোগী পরিবহনসেবা টেকসই আর্থসামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। একটি দক্ষ পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে সরকার মহাসড়ক নেটওয়ার্ক মেরামত, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ এবং সমন্বিত আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অভ্যন্তরীণ ক্রমবর্ধমান সড়ক নেটওয়ার্ক নির্মাণের পাশাপাশি আন্তদেশীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে উপ-আঞ্চলিক মহাসড়ক যোগাযোগ স্থাপনেরও কর্মপ্রয়াস চলমান আছে। সহজ ও আরামদায়ক যোগাযোগ এবং সড়ক নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়ে মহাসড়কগুলো পর্যায়ক্রমে চার বা চারের অধিক লেনে উন্নীতকরণ, সড়ক ডিভাইডার নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক সরলীকরণ, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ওভারপাস নির্মাণ, ট্রাফিক সাইন ও সিগন্যাল স্থাপন বা পুনঃস্থাপন, গাড়ি চালকদের প্রশিক্ষণসহ নানামুখী উদ্যোগ ও কার্যক্রম অব্যাহত আছে। দেশে সড়ক অবকাঠামোর অভূতপূর্ব উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে মোটরযানের সংখ্যা, যাত্রী এবং যানবাহনের গতি। সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবাইকে এগিয়ে আসার এবং ট্রাফিক আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সড়কের নিরাপত্তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না বলেই মনে হয়, যে কারণে কমছে না দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ-সংক্রান্ত কমিটির ১১১ সুপারিশের দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে সড়ক পরিবহন আইন। আর সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। তা না করা হলে প্রতি বছর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালনের কোনো গুরুত্ব থাকবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close