রেজাউল করিম খান

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক

আমরা সাধারণভাবে জানি, মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক বৈরীই হয়। বিশেষ করে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে মালিক ও শ্রমিক একে অপরকে বন্ধু ভাবেন না। শ্রমিকের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা ও নানা দাবি দাওয়া নিয়ে বিরোধ লেগেই থাকে। এই বিরোধ মাঝে মধ্যে বড় আকার ধারণ করে। র‌্যাব-পুলিশ আসে, লাঠি পেটা হয়, গুলি চলে, এমন কি- লাশও পড়ে। তবে এসবই হয় শ্রমিকের বিরুদ্ধে। ঘটনার পর মামলা হয়, তদন্ত হয়, কিন্তু সুবিচার হয় না। এর কারণ বড় শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা দেশের সরকার তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অথবা নিজেরাই সরকারের অংশীদার হন। তাদের হাতে প্রচুর অর্থ ও ক্ষমতা। এই কারণে আইন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মালিকের পক্ষে কাজ করতে বাধ্য হন। এদের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী থাকে। থাকে শ্রমিকদের মধ্য থেকে সংগ্রহ করা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত দালাল। তদুপরি মালিকের স্বার্থেই তৈরি করা হয়েছে শিল্প পুলিশ। সুতরাং এতসব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় অশিক্ষিত শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায় করতে পারেন না। তা সে দাবি যতই ন্যায্য ও বিধিসম্মত হোক।

সমাজ বিকাশের নিয়মানুসারে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমবিভাজন থাকেই। যে কারণে বুর্জোয়া ও শ্রমিক শ্রেণির গঠন প্রকৃতি সমস্তর ভিত্তিক হয় না। বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে তাই বিভিন্ন স্তর আছে, যেমন- বৃহৎ বুর্জোয়া, একচেটিয়া বুর্জোয়া, লুটেরা বুর্জোয়া, ফ্যাসিস্ট বুর্জোয়া, ফিনান্সিয়াল বুর্জোয়া, পাতি বুর্জোয়া, মধ্য বুর্জোয়া, ক্ষুদে বুর্জোয়া, ইত্যাদি। এদের মধ্যে স্বার্থ, নেতৃত্বের প্রশ্নে লড়াই সংগ্রাম চলে, ঘটে যুদ্ধের মতো ঘটনা। রক্তাক্ত খুনোখুনির ইতিহাসও ব্যাপক। কিন্তু বুর্জোয়াদের মধ্যে যতই যুদ্ধ বিগ্রহ থাকুক না কেন যদি কখনো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন সব স্তরের বুর্জোয়া শ্রেণি ও তাদের দলসমূহ একজোট হয়ে পুঁজিবাদ রক্ষার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। তখন তাদের কাছে গণতন্ত্র, মানবতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবকিছুই তুচ্ছ। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক শ্রেণিও অসমস্তর ভিত্তিক। রয়েছে একাধিক পার্টির অস্তিত্ব। শ্রেণি কাঠামোর মধ্যেই শ্রমিকরাও বিভিন্ন বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে থাকে। যেমন: পরিবহন শ্রমিক, কলকারখানার শ্রমিক, অফিস আদালতের কর্মচারী, কৃষি শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, বিশাল বেকার বাহিনী ইত্যাদি। জাতীয়তা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, পেশা, ভূগোল, নানাবিধ কারণে শ্রমিক শ্রেণির পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য বা বৈচিত্র্য রয়েছে। শ্রমিকের শ্রমে তৈরি উদ্বৃত্ত মূল্য বুর্জোয়ারা আত্মসাৎ করে। উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ না করলে বুর্জোয়া শ্রেণি বেঁচে থাকতে পারে না। এর অপর নাম শোষণ। শ্রমিক শ্রেণি যত স্তরেই বিভক্ত থাকুক কিংবা নিজেকে যতই স্বাধীন ভাবুক না কেন, বেঁচে থাকার জন্য তাকে শ্রম বিক্রি করতে হয় বুর্জোয়া শ্রেণির কাছেই। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক শ্রেণি মালিকের কাছে মজুরী দাসত্বে বন্দী হয়ে থাকে। পুঁজিবাদের মূল দ্বন্দ্ব শ্রম ও পুঁজির মধ্যে, দ্বন্দ্ব শ্রমিক শ্রেণি ও বুর্জোয়ার মধ্যে। রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বুর্জোয়া শ্রেণির উচ্ছেদ ও পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অবসানই এই দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটাতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এরপরও সমাজতন্ত্রে শ্রেণি থেকে যায়; তবে সেই শ্রেণিবিরোধগুলি লেনিনের মতে ‘অবৈরিতামূলক’।

ছোট ছোট শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের চিত্র অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। অনেক কষ্টে সংগৃহীত নিজস্ব পুঁজি অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তারা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কয়েক বন্ধু একত্রিত হয়ে পুঁজি বিনিয়োগের ইতিহাসও বিরল নয়। এইসব মালিকের লোকসানের ঝুঁকি থাকে; থাকে পুঁজি হারানোর ভয়। ফলে এরা শ্রমিক নিয়োগ করেন দেখে শুনে। অনেকে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত জনকেই কাজে লাগান আর সম্পর্ক ভালো রাখার চেষ্টা করেন। পরিবহন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, ওয়ার্কসপ, ছাপাখানা, বিসিক শিল্প নগরীতে স্থাপিত কলকারখানাসহ নানা পণ্যের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে পড়ে। এখানে নিয়োজিত শ্রমিকরাও প্রায় অশিক্ষিত। তবে অনেকে কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের কাজে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এদের অধিকাংশই মালিকের প্রতি অনুগত, পেশার প্রতি বিশ্বস্ত ও কর্মে দক্ষ। এদেরকে মালিক ভিন্ন চোখে দেখেন আর তাই বাড়তি সুবিধাও দেন। এইসব ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদেরও নিজস্ব সংগঠন আছে। এগুলি ট্রেড ইউনিয়ন নামে পরিচিত ও সরকারের শ্রম অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধিত। এই শ্রমিকদের জন্য বিধি ও আইন আছে, বিধি বাস্তবায়নের জন্য আছে অফিস ও কর্মকর্তা-কর্মচারী। কিন্ত শ্রমিকদের কল্যাণে তারা তেমন কিছু করেন না। তাদের সম্পর্ক মালিকের সঙ্গে!

কোনো উদ্যোক্তাকে তার ফ্যাক্টরি বা ব্যবসা চালু করার পূর্বে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। ট্রেড লাইসেন্সসহ সরকারি অনুমতি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে হয়। তবে ছোট প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ মালিক সবগুলো সংগ্রহ করেন না। ফলে অবৈধভাবে চলতে থাকে তার প্রতিষ্ঠান। এরজন্য সময়ে সময়ে বা নিয়মিতভাবে সংশ্লিষ্টদের ঘুষ দিতে হয়। মাঝে মধ্যে অভিযানে ও ভ্রাম্যমাণ আদালতে অর্থদন্ড দিতে হয়। কিন্তু ভুলত্রুটি সংশোধনের তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয় না। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানে একাধিক শ্রমিক কর্মচারি প্রয়োজন, সেখানে মালিককে যা করতে হয়, তা হচ্ছে শ্রমিকের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তাকে নিয়োগপত্র দেওয়া। এরজন্য নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র প্রদান এবং গোপনীয়তা রক্ষাকরণ নীতিমালা রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্য এই যে, ছোট ছোট মালিক তার প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিককে সরকারি বিধান মেনে নিয়োগপত্র দেন না। দোকান ও প্রতিষ্ঠানসমূহে সরকারি বিধি মেনে চলার বিষয়টি সরেজমিনে দেখার জন্য প্রতি জেলায় পরিদর্শক নিয়োজিত আছেন। অভিযোগ আছে, তিনি মালিকের অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে শ্রমিকের স্বার্থ উপেক্ষা করেন। মালিক তার ইচ্ছামতো মজুরি দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ করেন। তাছাড়া পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ শ্রমিককে যে মজুরি দেওয়া হয়, নারী শ্রমিককে দেওয়া হয় তার চেয়ে কম। অনেক প্রতিষ্ঠানেই কাজ করে শিশু শ্রমিক। এইসব প্রতিষ্ঠানের ইউনিয়নগুলো অনেকটাই অকার্যকর। শ্রমিক নেতারা চাঁদা তোলার ব্যাপারে যতটা উৎসাহী, শ্রমিকের দাবি আদায়ে ততটাই নিষ্ক্রিয়।

শ্রমিকের আত্মমর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করার, ন্যায্য দাবি আদায়ের এবং শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে যে শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত আন্দোলন-সংগ্রাম জারি রেখেছেন, তাদের আত্মত্যাগের প্রতি একাত্মতা, শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতেই হয়। এক্ষেত্রে শ্রমিক মালিকের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তথা ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। দেশের বিশাল শ্রমজীবী মানুষের যথাযোগ্য মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিতকরণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, শিশুশ্রম নিরসন, ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ, শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্কের মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং দারিদ্রমুক্ত উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার শপথ হোক বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকার। শ্রমিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বলেছে, মালিক শ্রমিক ঐক্যের জন্য দরকার শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশের বাস্তবতায় শ্রমিকরা যেখানে আছেন আর মালিকরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন সে অবস্থানে থেকে ঐক্য হওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই। শিল্প যখন থেকে সৃষ্টি হয়েছে তখন থেকেই মালিক শ্রমিক দরকষাকষি রয়েছে। এটি আগামীতেও চলবে। তারপরও অমরা বিশ্বাস করি, শ্রমিকরা ভালো থাকলে শিল্প ভালো থাকবে।

লেখক : সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close