টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নে ক্ষুধা এখনো বাধা
বাংলাদেশের জন্য ক্ষুধা একটি দীর্ঘকালীন সমস্যা, যা মোকাবিলায় গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বৈশি^ক ক্ষুধাসূচক (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স) ২০২৪-এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ১৯.৪ স্কোর নিয়ে ‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধার সমস্যায় ভুগছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে আমাদের অবস্থান ভারত, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো হলেও নেপাল ও শ্রীলঙ্কার তুলনায় আমরা পিছিয়ে রয়েছি। এ বাস্তবতা আমাদের একটি দ্বৈত চিত্র দেখায়- অগ্রগতি যেমন হয়েছে, তেমনই চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে চারটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে ক্ষুধাসূচক নির্ধারণ করা হয়েছে- অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের খর্বতা, ওজনহীনতা এবং শিশুমৃত্যুর হার। এ সূচকগুলো বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, অপুষ্টির হার এখনো ১১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং খর্বতার হার ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এটি প্রমাণ করে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভেতর এখনো বেশকিছু ত্রুটি রয়েছে। অনিরাপদ কৃষিচর্চা এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের বক্তব্য অনুযায়ী, কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার খাদ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে এবং পুষ্টিগুণও কমিয়ে দিচ্ছে। প্রাকৃতিক খাদ্য বৈচিত্র্য রক্ষা করা এবং নারীদের লোকজ জ্ঞানকে কাজে লাগানো তাই জরুরি।
ক্ষুধা সমস্যা শুধু কৃষির সীমাবদ্ধতায় আটকে নেই। এটি একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা, যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দরিদ্র মানুষের পক্ষে পুষ্টিকর খাদ্য কেনা সবসময় সম্ভব হয় না। এ কারণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোতে দরিদ্র ও বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো উন্নয়ন অংশীদাররা এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে সহায়তা করে আসছে। তবে সরকারের দায়িত্ব আরো বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন ক্ষুধার চক্রকে আরো জটিল করে তুলছে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধির মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ কৃষির উৎপাদনশীলতাকে হ্রাস করছে। এর সবচেয়ে বড় শিকার নারী ও কন্যাশিশুরা। তারা শুধু অপুষ্টির শিকারই নয়, বরং দুর্যোগের সময়েও তারা বেশি ভোগান্তির শিকার হয়। কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর মনিষ কুমার আগরওয়ালের মতে, জেন্ডার বৈষম্য দূর করা না গেলে ক্ষুধা দূর করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য কমিউনিটি-ভিত্তিক সমাধান এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা জরুরি। ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই কেবল সরকারি নয়, বেসরকারি সংস্থা, স্থানীয় কমিউনিটি, উন্নয়ন অংশীদার এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই সম্ভব। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্তির যে প্রতিশ্রুতি, তা অর্জনের পথ আমাদের এখনো দীর্ঘ। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে আমাদের উন্নয়ন হবে অসম্পূর্ণ। তাই এ মুহূর্তে দরকার সঠিক পরিকল্পনা, টেকসই কৃষি ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন।
ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এ চ্যালেঞ্জগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। অগ্রগতির যে যাত্রা আমরা শুরু করেছি তা যেন থেমে না যায় এবং দেশের প্রতিটি মানুষ যেন নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা পায়- এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
"