মো. জিল্লুর রহমান
বিশ্লেষণ
ইসলামের দৃষ্টিতে মানবাধিকারের তাৎপর্য
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিস শহরে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষার লক্ষ্যে একটি সাধারণ মানদণ্ড নির্ধারণ করে একটি সনদ গৃহীত হয়। এ সনদকে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সুরক্ষার সনদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এখন পর্যন্ত জাতিসংঘভুক্ত ১৯২টি দেশ এ সনদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে।
মূলত মানবাধিকার হচ্ছে কতগুলো সংবিধিবদ্ধ আইন বা নিয়মের সমষ্টি, যা মানব জাতির সদস্যদের আচার আচরণ ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বুঝায় এবং যা স্থানীয় ও আর্ন্তজাতিক আইন সমষ্টি দ্বারা সুরক্ষিত যা মৌলিক অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ বিষয় হিসেবে ধর্তব্য। অন?্য কথায় বলা যায়, দৈনন্দিন জীবনে চলার জন্য মানুষের যেসব অধিকার রাষ্ট্রের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত তাদেরকে মানবাধিকার বলে।
জন্মগতভাবে সব মানুষ স্বাধীন এবং সমান সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার শব্দটি বহুল আলোচিত ও বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। মানবাধিকারের বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ ও অলঙ্ঘনীয় হলেও সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই এ নিয়ে চলছে বাক-বিতণ্ডা, দ্বন্দ্ব সংঘাত ও মতভেদ। একদিকে মানবাধিকারের সংজ্ঞা ও সীমারেখা নিয়ে বিতর্কের ঝড় তোলা হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষমতাধর শাসকরা দেশে দেশে জনগণের স্বীকৃত অধিকারগুলো পর্যন্ত অবলীলায় হরণ ও দমন করে চলছে। আর দুর্বল জাতিগুলোর সঙ্গে সবল জাতিগুলোর আচরণ আজকাল মানবাধিকারকে একটি উপহাসের বস্তুতে পরিণত করেছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইসলামে মানবাধিকারের প্রধান ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) কর্তৃক মদীনা সনদ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। মদীনা সনদকে পৃথিবীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ লিখিত সংবিধান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এ সনদে মোট ৪৭টি অনুচ্ছেদ রয়েছে যেগুলোতে মানবাধিকারের বিষয়গুলো সর্বপ্রথম সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য অনুচ্ছেদসমূহে বলা হয়েছে সনদে স্বাক্ষরকারী সব সম্প্রদায় একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে এবং সব সম্প্রদায় সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। সব নাগরিক পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। নাগরিকদের অধিকার ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। সব ধরনরে রক্তক্ষয়, হত্যা ও ধর্ষণ নিষিদ্ধ। কোনো লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হবে। তার কারণে অপরাধীর সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না। দুর্বল ও অসহায়দের সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে।
ইসলাম হলো সর্বশেষ একেশ্বরবাদী ধর্ম। ইসলামে সার্বজনীন মানবাধিকারের বিষয়টি জীবনের সর্বক্ষেত্র ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত। ইসলাম মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের গৌরবময় অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করেছে। মানুষকে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের মর্মবাণী শুনিয়ে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, বংশীয় মর্যাদা, শ্রেণিবৈষম্য ও বর্ণপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেছে। অধীনদের প্রতি সদাচারী ও ন্যায়পরায়ণ হতে শিক্ষা দিয়েছে। আরব-অনারব, সাদা-কালো সবাই একই পিতা-মাতা হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) এর সন্তান। মানুষের মধ্যে মর্যাদার কোনো পার্থক্য হতে পারে না। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানবজাতির সম্মান ও মর্যাদার অধিকার, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি জীবনযাত্রার মৌলিক অধিকার, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার, জীবনরক্ষণ ও সম্পদের নিরাপত্তার অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, একতা, সংঘবদ্ধ ও সাম্যের অধিকার, হালাল উপার্জনের অধিকার, এতিম, মিসকিন, অসহায় নারী ও শিশুর অধিকার, প্রতিবেশির অধিকার, কৃষক-শ্রমিকের অধিকার, প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রভৃতি সব ব্যাপারেই পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা ও কালজয়ী চিরন্তন আদর্শ হিসেবে ইসলাম মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা ও দিক নির্দেশনা প্রদান করেছে।
ইসলামি শরিয়তের বিধানে মানবাধিকার সংক্রান্ত পাঁচটি প্রধান ধারা নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা: জীবন রক্ষা, সম্পদ রক্ষা, বংশ রক্ষা, জ্ঞান রক্ষা ও ধর্ম রক্ষা। মূলত মানবতার সুরক্ষা বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল লক্ষ্য এবং মুখ্য উদ্দেশ্য। সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতে মহান আল্লাহ রাসুল (সা.) কে বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্ব জগতের প্রতি কেবল রহমত/আশির্বাদ রূপে প্রেরণ করেছি।’ এক্ষেত্রে রাসুল (সা.) কে আল্লাহ কেবল মুসলিমদের জন্য আশির্বাদ স্বরূপ প্রেরণ করেন নাই, অমুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সমগ্র মানবজাতির জন্য, জ্বীন জাতি, পশু-পাখি, জীব-জন্তু, গাছ-পালা, নদী-নালা, পাহার-পর্বত সব সৃষ্ট বস্তুর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। বোখারি শরীফে বলা হয়েছে, যে মানুষের কল্যাণ করে, সেবা করে সেই সর্বোত্তম ব্যক্তি। এখানে মুসলিম মোত্তাকি বলা হয়নি, মানুষ বলা হয়েছে, মুসলিম, অমুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সব মানুষের সেবার কথা বলা হয়েছে।
ইসলাম ধর্মের প্রচারক নবী মুহাম্মদ (সা.)। তার উপর নাজিলকৃত কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন স্থানে মানবাধিকারের বিষয় বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষণেও মানবাধিকারের কথা সংক্ষিপ্ত অথচ স্পষ্ট করে বলে গেছেন। এই ভাষণে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছিল। সমগ্র মুসলিম জাতির সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে মুহাম্মাদ (সা.) চূড়ান্ত দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল উপাসনামূলক অনুশাসন ছিল না, বরং মানবসমাজের জন্য করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও এতে ছিল। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, তার সার্বভৌমত্বের সাক্ষ্য, মানবজাতির ঐক্য, আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক সাম্য ইত্যাদি সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম সব বিষয়ই এই ভাষণের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই ভাষণে তাকওয়া বা দায়িত্ব নিষ্ঠতার কথা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং পাপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব ও মানব সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব ইবাদের মধ্যে সীমারেখা টেনে দেওয়া হয়েছিল। মুহাম্মদ (সা.) এই ভাষণে সমাজ ও রাষ্ট্রে অরাজকতা, বিদ্রোহ এবং কুপরামর্শ প্রদানকারী শয়তানদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেছেন। এই ভাষণে বিভিন্ন ধরনের সুদ প্রথা রহিত করে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য মুসলমানদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই ভাষণে। মানুষে মানুষে আত্মীয়তার বন্ধন, বিশেষ করে রক্তের সম্পর্কের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। সামাজিক কুসংস্কার থেকে মানুষের মুক্তি লাভের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। মুহাম্মদ (সা.) এর এই ঐতিহাসিক ভাষণে স্বর্গ-মর্ত্যের সব কিছুর ওপর আল্লাহর কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করা হয়েছিল এবং মানুষকে এসব কিছুর আমানতদার হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহর মালিকানায় সবার অধিকার স্বীকৃত বলে উত্তরাধিকার আইনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ
করা হয়েছিল। আমানতের খেয়ানতকারীর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল। মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ
করা হয়েছিল। সাম্য, স্বাধীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, ভ্রাতৃত্ব এবং বদান্যতা ও মানবতার পরম ধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
ইসলামের শান্তির বাণী শুধু নিজ ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং পরমত ও পরধর্মের প্রতি সহনশীলতা ও সহানুভূতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্যে গুরুত্ব দেন রাসূল (সা.)। উম্মার ধারণার মধ্যে অন্যান্য ধর্মের স্বাধীনতা ও অধিকার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এক্ষেত্রে ইসলাম সব মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-অনাত্মীয়, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, ধনী-গরিব, জাতি ও ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানবসন্তানই মানবাধিকারে সম অধিকারী। মানুষের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্যই আল্লাহ তাআলা অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন, অনেক কিতাব নাজিল করেছেন; শরিয়তের বিধান দিয়েছেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠা মানেই সার্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। নারী ও শিশু বিশেষত কন্যাশিশু এবং অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মানবাধিকার সুরক্ষা করা সামর্থ্যবান সব নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব এবং সব মুসলমানের ঈমানি কর্তব্য।
সুতরাং, ইসলামে মানবাধিকারকে খণ্ডিতভাবে দেখার সুযোগ নেই। এখানে নিজ সমাজের সুবিধার জন্য অন্যায়ভাবে অপরকে ক্ষতিগ্রস্থ করার সুযোগ নেই। একে সমাজ-রাষ্ট্রের
সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিকভাবে দেখতে হবে। তাই ইসলামের মানবাধিকারের ধারণায় রয়েছে অখণ্ড ও সুদূর প্রসারী
তাৎপর্য। এর সঙ্গে মানুষের ইহলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি জড়িত। ফলে মুমিনের পক্ষে মানবের অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি অপরিহার্য।
লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক
"