বিভূতি ভূষণ মিত্র
মুক্তমত
ইটভাটায় প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি
আইন অনুসারে ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত, সেখানকার জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া ছাড়া কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করতে পারবে না এবং ইটভাটা ছাড়া কোথাও ইট প্রস্তুত করা যাবে না। আইনে মাটি ব্যবহার-সংক্রান্ত কথাও বলা আছে। এতে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি ইট তৈরি করার জন্য কৃষিজমি, পাহাড় বা টিলা থেকে মাটি কেটে ইট তৈরি করতে পারবে না। তবে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে মজা পুকুর, খাল-বিল, দিঘি, নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল বা পতিত জায়গা থেকে মাটি কেটে তা ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। এই আইনের ছয় ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে কোনো জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করতে পারবে না। ৮ ধারায় বলা হয়েছে, ছাড়পত্র থাকুক বা না থাকুক; আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি, কৃষিজমি, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় সীমানার ভেতরে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না।
এসব বিধি লঙ্ঘন করলে শাস্তিরও বিধান রাখা হয়েছে। ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যক্তি ইটভাটা স্থাপন করলে, পরিচালনা বা চালু রাখলে এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এ ছাড়া ১৫ ধারামতে, ইট তৈরি করার জন্য কৃষিজমি, পাহাড় বা টিলা থেকে মাটি কেটে সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করলে বা জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া ইট তৈরির জন্য মজা পুকুর, খাল-বিল, দিঘি, নদী, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল, পতিত জায়গা থেকে মাটি কাটলে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এ ছাড়া ইটভাটায় জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করলে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
২০২৩ সালে এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা ৭৪ মাইক্রোগ্রাম। ভারতে ৫৮ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম ও চীনে ৩০ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম একই সময়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর কমপক্ষে ৬ দশমিক ৮ বছর আয়ু কমে যাচ্ছে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের তথ্যমতে, বিশ্বে দূষণের তালিকায় শীর্ষে এখন ঢাকা। শহরটির এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর এখন ২৮০; সংস্থা অনুযায়ী। পাকিস্তানের লাহোরের স্কোর ২৩৪, ভারতের দিল্লির ২২৪ এবং কলকাতার ১৯০।
ক্লিন এয়ার ফান্ডের একটি তথ্যমতে, স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি ফান্ডিং ২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বায়ুর গুণগত মান উন্নয়নের তহবিলপ্রাপ্তিতে তৃতীয় ছিল বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি কারণ হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণকাজে সৃষ্ট ধোঁয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি তথ্যমতে, প্রতি বছর বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে আনুমানিক ৩০ লাখ মানুষ মারা যায়। স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যানসার ও অন্যান্য রোগ, শ্বাসযন্ত্রের নানা সংক্রমণ হতে পারে এসব বায়ুদূষণের কারণে। এমনকি ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুরও দেশের সবচেয়ে দূষিত জেলা। এখানকার মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে ৮ দশমিক ৩ বছর।
সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে পরিবেশ উপদেষ্টা নতুন করে ইটভাটার ছাড়পত্র দেওয়া হবে না বলে জানান। এ ছাড়া ৩ হাজার ৪৯১টি ইটভাটার ছাড়পত্র নেই বলে জানান। এসব ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হবে বলেও জানান। পার্বত্য এলাকায় যেসব ইটভাটা রয়েছে, সেসবও স্থানান্তর করা হবে। এসব ভালো উদ্যোগ। বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের আগ্রহও ভালো ছিল। তারা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইট তৈরির বিষয়ে গুরুত্ব দেন।
ইটের বিকল্প হিসেবে অপোড়ানো ব্লক ব্যবহারের ব্যাপারে সরকার এগিয়ে আসতে পারে। এই ব্লক ব্যবহার একটি ভালো পরিকল্পনা। এ নিয়ে সরকার আরো ভালো উদ্যোগ নিতে পারে। একই সঙ্গে ছাড়পত্রবিহীন ইটভাটা বন্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
"